মিউনিখে ইরান-ইসরায়েল কথার লড়াইয়ে নতুন উত্তেজনা

জার্মানির মিউনিখে চলমান নিরাপত্তা সম্মেলনে কথার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েল ও ইরান। গত সপ্তাহে ‍সিরিয়ায় ইরানি সামরিক ঘাঁটিতে ইসরায়েলি বিমান হামলা ও সিরিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুলিতে ইসরায়েলি যু্দ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এরপর থেকেই ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মিউনিখ সম্মেলনে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ হাতে হাজির হন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেখানে তিনি ইরানকে ‘বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে অ্যাখ্যা দেন। তবে তার বক্তব্যের পরই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নেতানিয়াহুর বক্তব্যকে ‘কার্টুনসুলভ সার্কাস’ বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ

দীর্ঘদিন পর গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো ইসরায়েল ও ইরানি সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ইরানি ড্রোন ইসরায়েলের আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ সিরিয়ায় ইরানি ঘাঁটি ও অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এ সময় সিরীয় বাহিনীর গুলিতে ভূপাতিত হয় ইসরায়েলের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। বলা হচ্ছে, ২০০৬ সালের পর এই প্রথমবারের মতো কোনও ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলো। এরপর থেকে নেতানিয়াহু বলে আসছেন, ইরান নির্লজ্জভাবে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করছে। তবে ইসরায়েল নিজেই তাদের প্রতিহত করতে পারবে। আর ইরান ড্রোন চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।

ইসরায়েলের দাবি মতো ইরানি ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ হাতে নিয়ে মিউনিখে নিরাপত্তা সম্মেলনে ভাষণ দিতে হাজির হন নেতানিয়াহু। এসময় তিনি ইরানকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ ও হুমকি দেন। ইরানকে ‘বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইসরায়েল তার আশেপাশের রাজ্যে ইরানকে নাক গলাতে দিবে না।’

নিজের বক্তব্যে নেতানিয়াহু ২০১৫ সালে করা ইরানের পরমাণু চুক্তিকে ১৯৩৮ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য করা মিউনিখ চুক্তির সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ওই চুক্তির মাধ্যমে ‘বিপজ্জনক ইরানি বাঘকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।’ সম্মেলনে ইরানের প্রতিনিধি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জাফরিকে মিথ্যাবাদী বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি তাকে ‘ইরান সরকারের সুন্দর মুখপাত্র, যিনি গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারেন’ বলে অভিহিত করেন।

ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ হাতে মিউনিখে ভাষণ দেন নেতানিয়াহু

নেতানিয়াহু বলেন, ‘গত সপ্তাহে ইসরায়েলি সীমান্তে সেনাবাহিনীর গুলিতে বিধ্বস্ত হওয়া ড্রোন বিমানটি যে তারাই পাঠিয়েছে তা মিথ্যাচার করে অস্বীকার করেছে ইরান।’ একটি ধ্বংসাবশেষ হাতে তুলে ধরে জাফরিকে লক্ষ্য করে নেতানিয়াহু সরাসরি বলেন, ‘আপনি এটা চিনতে পারছেন? আপনার পারা উচিত। এটা আপনাদেরই। আমাদের পরীক্ষা করবেন না!’ তিনি দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক চুক্তির মধ্য দিয়ে ভয়ংকর ইরানি বাঘকে মুক্ত করা হয়েছে এবং নিজেদের রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে ইসরায়েল কোনও দ্বিধা করবে না।

নেতানিয়াহুর ওই ব্ক্তব্যের পরপরই একে ‘কার্টুনসুলভ সার্কাস’ বলে মন্তব্য করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ বলেন, নেতানিহয়াহু ‘কৌশলগত ভুলের বৈধতা দিতে অথবা অভ্যন্তরীণ সংকট এড়াতে কার্টুনের সহায়তা নিচ্ছেন। এটা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মতো উপযুক্ত নয়।

জাভেদ জারিফ অভিযোগ করেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আক্রমণকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কয়েকদিন আগে সিরিয়ায় হামলা চালানোর সময় ইসরায়েলের এফ-১৬ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পুরো বক্তব্যে মূল বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে তাদের তথাকথিত অপরাজেয়তা নষ্ট হয়ে গেছে। ইসরায়েল প্রতিবেশি দেশগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণকে নীতি হিসেবে ব্যবহার করছে।’

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইসরায়েলে দুর্নীতির অভিযোগ ও বিক্ষোভের বিষয়ে ইঙ্গিত করে জারিফ বলেন, ‘এটাই আক্রমণের সমস্যা। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি আরেকটি সমস্যা। আমি সে বিষয়ে কথা বলছি না।’

ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সিরিয়ায় ইসরায়েলের এই হামলা ও ইরানের সহায়তায় তা প্রতিরোধের ঘটনা দেশটিতে সাত বছরের যুদ্ধে বিবাদমান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে আবারও মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইরান ও তাদের সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী প্রেসিডেন্ট আসাদকে সমর্থন করে আসছে। এর আগে ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধান সিরিয়ার আকাশ সীমায় প্রবেশের ব্যাপারে ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আধিপত্যের রাজনীতিতে ইসরায়েল আর ইরানের অবস্থান পরস্পরের বিপরীতে। সৌদি-ইসরায়েল মৈত্রী মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির অনুসারী। বিপরীতে ইরানের অবস্থান মার্কিন আধিপত্যের বিপরীতে। সিরিয়ায় মার্কিন আধিপত্যের বিরোধী হওয়ার কারণেই ইরান সিরীয় যুদ্ধে আসাদ সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইসরায়েল সবসময়ই তাদের ওপর ইরানি হামলার আশঙ্কার কথা প্রচার করে আসছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত যেকোনও সময় ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর হুমকি দেন। সূত্র: বিবিসি, হারেৎজ।