সিরীয় যুদ্ধ: তুরস্কের আফরিন দখল কিসের ইঙ্গিত

প্রায় দুই মাসের ধারাবাহিক অভিযান শেষে সিরিয়ার আফরিনে কুর্দিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় দাবি করেছে তুরস্ক। তুর্কি বাহিনী ও সিরিয়ার বিদ্রোহী সংগঠন ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) যৌথভাবে আফরিনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।তুর্কিদের আফরিন দখলের ঘটনা নানমুখী ও জটিল সিরীয় যুদ্ধে নতুন মোড় নিয়ে আসতে পারে।

dcf07351cabf876fe24a4d532fe11208c0fbca21

২০ জানুয়ারি কুর্দি পিপল’স প্রটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন আফরিনে সামরিক অভিযান শুরু করে তুরস্ক। তুর্কিদের কাছে ওয়াইপিজি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং তুরস্কে নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) শাখা বলে পরিচিত। তুরস্কের অভিযানের লক্ষ্য ছিল, আফরিন থেকে কুর্দিদের উৎখাত করা।

শহরটি দখল তুর্কিদের বড় ধরনের সাফল্য। এর ফলে উত্তর সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের যে সীমান্ত রয়েছে সেখানে দেশটির নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত হয়েছে। এর আগ থেকেই তুরস্ক এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহযোগিতা করে আসছে।

মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের রফিক হারিরি সেন্টারের  অ্যারন স্টেইন বলেন, তুর্কিরা জয় পিপাসু। তারা সব সময় জয়ী হতে চায়। তারা সিরিয়ার আরেকটি ভূখণ্ড দখল করেছে এবং তারা অঞ্চলটিকে তুর্কি শাসন কাঠামোয় নিয়ে আসবে।

স্টেইন মনে করেন, সিরীয় ভূখণ্ড জয়ের ফলে তুরস্ক সিরীয় শরণার্থীদের সেখানে পাঠাতে পারে।

সিরিয়ার সাত বছরের গৃহযুদ্ধে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গৃহহারা হয়েছেন দেশটির অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ত্রিশ লাখ সিরীয়।

সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির নিরাপত্তা গবেষক নিকোলাস হেরাস জানান, আফরিন দখল তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের জন্য একটি সাফল্য। যিনি এই সামরিক অভিযান নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ছিলেন।

নিকোলাস বলেন, উত্তরপূর্ব সিরিয়ায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা আফরিন। এই ভূখণ্ডটি আগামী দিনে এ অঞ্চলে তুর্কিদের উপস্থিতির ঘাঁটি হবে।

আফরিন দখলের মধ্যেই তুরস্কের অভিযান শেষ হয়ে যাবে না। এরদোয়ান আগেই বারবার বলেছেন, আফরিন দখল করেই তুর্কিরা ক্ষান্ত হবে না। ইরাক সীমান্তের কাছে ওয়াইপিজি নিয়ন্ত্রিত আরেকটি শহরের দিকেও এগিয়ে যাবে তুর্কি বাহিনী।

কুর্দিদের জন্য আফরিনের নিয়ন্ত্রণ হারানো বড় ধরনের পরাজয়। সংঘাতপূর্ণ গত সাত বছর ধরে কুর্দিরা এখানে সুসংহত অবস্থানে ছিল। এলাকাটিকে ঘিরে কুর্দিরা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তুর্কিদের অভিযানের আগে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটি রোজাভা হিসেবে হিসেবে পরিচিত। অঞ্চলটি বিস্তৃত ছিল উত্তর ও উত্তরপূর্ব সিরিয়া পর্যন্ত। আফরিনের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে কুর্দিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের একটি হাতছাড়া হয়ে গেলো। এর মধ্য দিয়ে কুর্দিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নও ফিকে হয়ে আসছে।

কুর্দি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মুটলু চিবিরগলু জানান, কুর্দিদের নিজেদের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আফরিনে পরাজয় বড় ধরনের ধাক্কা। এখন কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য অঞ্চলও হুমকির মুখে পড়েছে।

তুরস্কের বিরুদ্ধে কুর্দিদের সশস্ত্র সংগ্রামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আইএসবিরোধী যুদ্ধ থেকে কুর্দিরা সরে এসেছে। কুর্দিরা সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)-এর গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল। যারা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটকে সহযোগিতা করেছে। মার্চের শুরুতে এসডিএফ জানিয়েছিল, তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফরিনে তাদের ১ হাজার ৭০০ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

আফরিনের লড়াই প্রধানত কুর্দি ও তুরস্কের মধ্যে হলেও আফরিন তুর্কিদের দখলে চলে যাওয়া সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের জন্যও এক ধরনের পরাজয়। সিরিয়ার সরকারি বাহিনী তুরস্কের অভিযানের বিরোধিতা করেছে। আসাদ সমর্থিত যোদ্ধাদের তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরোক্ষ সম্মতি দেওয়া হয়েছে এবং কুর্দিদের সহযোগিতা করা হয়েছে।

আসাদ ও সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া সমর্থিত বাহিনী যখন দেশটির অন্যান্য স্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তখন তুরস্ক আফরিনের দখল নিল। এর মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশলগত অঞ্চল সিরিয়ার হাতছাড়া হয়েছে।

বিশ্লেষক হেরাস বলেন, তুর্কি সেনারা সিরিয়ার যেসব এলাকা দখল করছে তা দামেস্কর একেবারে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও সিরিয়ার যেসব ভূখণ্ড তুরস্ক দখল করেছে তা মস্কোর আশীর্বাদেই সম্ভব হয়েছে। সূত্র: এএফপি।