জামাল খাশোগি নিখোঁজ রহস্যে জটিল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

সৌদি আরব থেকে নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাশোগি তুরস্কের ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেট থেকে নিখোঁজ হওয়ার রহস্যে জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দুটি দেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক। আর এই জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। তুরস্ক সতর্ক ও সাবধানী কৌশলে পরিস্থিতি মোকাবিলার পথে হাঁটছে। রিয়াদের সঙ্গে বড় কোনও কূটনৈতিক ঝামেলায় জড়াতে চায় না আঙ্কারা। আর ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি যুবরাজের প্রতি আস্থাশীল হলেও তুরস্কে একটি কনস্যুলে মার্কিন ও দেশটির সমালোচক কলামিস্টকে এভাবে হত্যার ঘটনায় কংগ্রেস সৌদি আরবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চাপ দেবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে।

skynews-jamal-khashoggi-saudi-journalist_4446084

মঙ্গলবার দুপুরে ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন খাশোগি। এরপর আর তাকে দেখা যায়নি। তুরস্কের তদন্তকারীরা বলছেন, সৌদি আরবের ১৫জন এজেন্ট খাসোগিকে হত্যা করেছে কনস্যুলেটের ভেতরে। একথা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। তুর্কিশ আরব মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান তুরান কিসলাকসি জানান, তাকে কর্মকর্তা বলেছেন, খাশোগিকে হত্যা এবং লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। সৌদি আরব এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করে আসছে, কনস্যুলেটে প্রবেশের কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বের হয়ে গেছেন।

রবিবার এসে খাশোগির নিখোঁজ বিতর্ক মধ্যপ্রাচ্যের দুই গুরুত্বপূর্ণ শক্তির মধ্যকার সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলেছে। যদি হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে থাকে তাহলে পশ্চিমাদের সঙ্গে সৌদি আরবের বিশেষ করে দেশটির প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে। যুবরাজ পশ্চিমাদের কাছে সৌদি আরবের যে চিত্র তুলে ধরতে চাইছেন এবং সামাজিক সংস্কারে হাত দিয়েছেন এই হত্যাকাণ্ড বিপরীত বার্তা দেবে।

তুর্কি কর্মকর্তারা রবিবার সৌদি আরবের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন কেন খাশোগি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর বের হয়ে আসেননি। রবিবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তুরস্কের ক্ষমতাসীন একেপি পার্টি প্রধানের উপদেষ্টা ইয়াসি আকতায় বলেন, ’আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। এটা অসমাপ্ত ঘটনা হিসেবে থাকবে না।’ কর্মকর্তারা খাশোগিকে হত্যার অভিযোগটি প্রকাশ্যে জানাননি বা তাদের এই অভিযোগ সম্পর্কে কোনও তথ্য-প্রমাণ হাজির করেননি। ফলে আঙ্কারা এই অভিযোগের পক্ষে দাঁড়াবে কিনা- সেই প্রশ্ন হাজির হয়েছে। কিংবা হয়ত সৌদি আরবের সঙ্গে  বিরোধ এড়াতে চায় তুরস্ক।

তুরস্কের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সরকার অপেক্ষা করছে তদন্ত পুরোপুরি শেষ হওয়ার জন্য। তদন্ত শেষ হলে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও প্রমাণ হাজির করা হবে। কারণ এটা স্পর্শকাতর কূটনৈতিক ইস্যু। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান।

রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বিষয়টি সম্পর্কে একেবারে অল্প কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমি বিষয়টির দিকে নজর রাখছি। তদন্ত থেকে যে উপসংহারই আসুক আমরা বিশ্বকে তা অবহিত করব।

এরদোয়ানের বক্তব্যে তুরস্কের সতর্কতামূলক অবস্থানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অতীতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিরোধ এড়িয়ে ভারসাম্য রক্ষা করেছে আঙ্কারা ও রিয়াদ। যদিও তাদের মধ্যে বিব্রতকর ইস্যু এখনও রয়েছে। যেমন কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের পর আঙ্কারা দাঁড়িয়েছে দোহার পাশে। এছাড়া মিসরে ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যূত্থান ও মুসলিম ব্রাদারহুড ইস্যু নিয়েও দুটি দেশের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচে সৌদি আরবের চেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে গুরুত্ব দেয় তুরস্ক।

4548

রাজনীতিক বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে হত্যার অভিযোগ তোলার মধ্যদিয়ে বিষয়টি কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করছে এরদোয়ানের প্রশাসন। ঋণে জর্জরিত তুরস্কের পক্ষ থেকে ইস্তানবুলে কনস্যুলেটে কাউকে হত্যার অভিযোগ তোলাটা বেশ গুরুতর মনে করা হচ্ছে। কারণ এর ফলে উভয় দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।

এক বছরেরও কম সময় আগে সৌদি যুবরাজ লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে অপহরণ করেছিলেন। এরপর হারিরিকে কয়েক কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তি লিখে দিতে হয়। যেমনটা দিয়েছেন সৌদি আরবের রাজ বংশ ও অভিজাতদের। এরপর যুবরাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কঠোর দমন চলে। এ সময় সৌদি আরবের বিশেষ করে যুবরাজের সমালোচকে পরিণত হন খাশোগি। সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা খাশোগি শুধু সমালোচক নন, পরিণত হয়েছেন একটা হুমকিতে। হুমকি নিশ্চিহ্ন করতে রাশিয়া যেমন গুম ও হত্যার পর অস্বীকার করে, এক্ষেত্রে সৌদি আরবও ক্রেমলিনকে অনুসরণ করছে। আর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেওয়া তুরস্ক পড়েছে জটিল পরিস্থিতিতে। কারণ খাশোগির মতো কলামিস্ট হাওয়া হয়ে গেছেন তাদের নাকের ডগায়।

এই নিখোঁজ রহস্য ওয়াশিংটনেও জটিলতা তৈরি করছে। সাবেক ও বর্তমান মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে খাশোগির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এবং তিনি দেশটির নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি দূতাবাসে কাজ করেছেন নির্বাসনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। সৌদি শাসকদের অনানুষ্ঠানিক মুখপাত্র হিসেবে তাদের সঙ্গে কাজ ও সম্পর্ক ছিল তার। সম্প্রতি তিনি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এর হয়ে কলাম লেখা শুরু করেছেন। এই কলাম লেখার মাধ্যমেই সৌদি আরবের নাগরিক হয়েও দেশটির সমালোচক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

খাশোগি রহস্য এমন সময় সামনে আসলো যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে শায়েস্তা করতে চায়, এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব তাদের প্রধান সহযোগী। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বি ইরানকে কোনঠাসা করতে সৌদি আরবও দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে। এমনিতেই ইয়েমেনে সৌদি জোটকে সমর্থন ও সহযোগিতার কারণে সমালোচনার মুখে রয়েছে সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক। এর মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অপমান করেছেন সৌদি যুবরাজ সালমানকে। তিনি বলেছেন, ’যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া যুবরাজ দুই সপ্তাহও ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না’। ট্রাম্পের এমন অপমান শান্তভাবে মোকাবিলা করেছেন যুবরাজ। যদিও বলেছেন, ’যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সৌদি আরব সবকিছুই কিনে নেয়। নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে এক পয়সাও দেওয়া হবে না’।

এই পরিস্থিতিতে তুর্কি কর্মকর্তারা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে হত্যার যে অভিযোগ এনেছেন তা যদি সত্যি হয় কিংবা খাশোগির নিখোঁজ হওয়ার পেছনে সৌদি সম্পৃক্ততা থাকে তাহলে রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের চাপের মুখে পড়তে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ’খাশোগির কী ঘটেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। ঘটনাটির দিকে তাদের নজর রয়েছে’। তবে উদ্বেগ জানিয়েছেন মার্কিন রাজনীতিকরা। কানেক্টিকাটের ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস মার্ফি জানান, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড যারা ঘটাতে পারে তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। টুইটারে তিনি লিখেছেন, এটা যদি সত্যি হয় যে, সৌদি আরব তাদের কনস্যুলেটে একজন মার্কিন নাগরিককে হত্যা করেছে, তাহলে তাদের সঙ্গে সম্পর্কে বড় ধরনের ছেদ পড়া উচিত।

Untitled-1

ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাট সিনেটর টিম কেইন বলেন, কী ঘটেছে তা খতিয়ে দেখতে আমাদের গভীরে যাওয়া দরকার এবং দৃঢ় প্রতিক্রিয়া জারি করা উচিত। সাংবাদিকদের হত্যা করা বন্ধ করতে হবে।

ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের সিনেটর মার্কো রুবিও বলেছেন, যদি এই ভয়াবহ খবর সত্যি হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং সভ্য বিশ্বের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সিনেটে পর্যালোচনার সম্ভাব্য সবকিছু আমি করব।

সৌদি আরব এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসলেও তারা কোনও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়নি। ইস্তানবুল কনস্যুলেটের এক বিবৃতিতে অজ্ঞাত তুর্কি কর্মকর্তাদের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অজ্ঞাত ব্যক্তি তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে।

উল্টো তুরস্ক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছে সৌদি আরবের অনুরোধে খাশোগির নিখোঁজের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সৌদি আরব তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিয়ে চিন্তিত। তারা যে কোনও দেশেই হোক না কেন। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।