অর্থনৈতিক সংকটে ব্যর্থ হবে এরদোয়ানের উচ্চাভিলাষ?

বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণেই ব্যর্থ হতে পারে তুরস্ককে ঘিরে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের উচ্চাভিলাষ। অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব যেমন পড়েছে তুরস্কের থেমে যাওয়া মেগা প্রজেক্টের ওপর, তেমনি দেশটির সাধারণ মানুষের অনেকে আস্থা হারিয়েছেন তার ওপর থেকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তাই এরদোয়ানের বর্তমান অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে অর্থনীতির সমৃদ্ধির কারণে এক সময় ক্ষমতা সংহত করতে পেরেছিলেন এরদোয়ান, সেই অর্থনীতিরই সংকটের কারণে পতন হতে পারে তার।

ipanews_f8968c93-80a5-48d5-8b87-c27838203a65_1

ইস্তানবুলের ফিকিরতেপে আধুনিক এক শহরের পরিকল্পনা করেছিল এরদোয়ান সরকার। ইস্তানবুলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্মারক হয়ে ওঠার কথা ছিল প্রকল্পটির। পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, এতে যেমন থাকবে অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, তেমনি থাকবে শপিং মল-স্পা। এ বিষয়ে ২০১০ সালে একটি প্রচারণামূলক ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঘরছাড়া হতে হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে। অন্যদিকে প্রকল্পে মালিকানা পাওয়ার জন্য আগাম অর্থ জমা দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু তুরস্কের অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে সব থমকে আছে। পরিকল্পনায় থাকা অধিকাংশ ভবনই পড়ে আছে অসমাপ্ত অবস্থায়। আগামী ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য স্থানীয় নির্বাচনের বিষয়ে আয়োজিত জনমত জরিপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, আঙ্কারার নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে এরদোয়ানের একে পার্টি। হারতে হতে পারে ইস্তানবুলেও।

ফিকিরতেপের প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন জিনেপ ডুজগুনোলদু (৬০)। কান্নাভজে কণ্ঠে তিনি জানিয়েছেন, প্রকল্পের জন্য ভাঙা পড়েছে তার বাসস্থান। জিনিসপত্র রাখার ব্যাগটিই এখন তার বাড়ি। তিনি বলেন, ‘সরকার অত্যন্ত নির্দয়। তারা আমাদের থাকার জায়গার ভাড়া দেবে বলেছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর তারা সব ভুলে গেছে। আমরা প্রতারিত হয়েছি। ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে অর্থ চাইতে আমার কুণ্ঠাবোধ হয়।’

এমন আরেকজন হলেন ফিরদেভস উলউওক্যাক। নির্মাণ কাজের সময় তার বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার ক্ষোভের লক্ষ্য একজনই; তুরস্কের ‘বিল্ডারদের’ প্রধান এরদোয়ান। উলউওক্যাক মন্তব্য করেছেন, ‘আমি তাকে ঘৃণা করি। আমি সবসময় তাকে ভোট দিয়ে এসেছি। কিন্তু তিনি মানুষের জীবন ধ্বংস করেছেন।’

এতদিন ধরে তুরস্কের যে উন্নতি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে এরদোয়ানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সিদ্ধান্ত। তিনি বড় বড় বিমানবন্দর থেকে শুরু করে টানেল পর্যন্ত বানানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তার শাসনামলে হাউজিং ও ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিগুলো ভবন বানাতে বানাতে ছেয়ে ফেলেছে আকাশ। এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠ এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে নেয় সরকারি কাজ। তুরস্কের এই খাত দুর্নীতির অভিযোগে ভারাক্রান্ত। আর এদিকে থমকে আছে ফিকিরতেপের মতো প্রকল্প।

তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতির হার ২০ শতাংশ। দেশটির মুদ্রা লিরার মান কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। একদিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদেশি ঋণ পরিশোধে, অন্যদিকে নির্মাণ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। অর্থনীতির এই বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর চেষ্টা করছেন এরদোয়ান। নিজের পক্ষে ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন তিনি; নিউ জিল্যান্ডের দুই মসজিদে হওয়া ভয়ঙ্কর হামলার ভিডিও দেখিয়েছেন একাধিক নির্বাচনি সভায়।

এই দুর্বল অর্থনীতির প্রভাবের বিষয়ে ফিকিরতেপ প্রকল্পের প্রধান পানা ইয়াপি বলেছেন, ‘পুরো দেশ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়েছে তাদের ওপরেও।’

ইস্তানবুল ইকোনমিকস রিসার্চের প্রধান ক্যান সেলকুকি বলেছেন, ‘বিদেশি ঋণের ওপর তুরস্ককে বহুলাংশে নির্ভর করতে হয়। আর তা যখন পরিশোধ করতে সমস্যা হয় তখন সেই রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে পরিস্থিতিতে আমরা আছি। আমাদের জন্য হতো সামনে বড় একটা বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। তা এড়ানোর জন্য দরকার বিপুল বৈদেশিক ঋণ। সেক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হতে হবে।’ যদিও এরদোয়ান আইএমএফের কাছ থেকে আর কখনও ঋণ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সেলকুকি যুক্তি দিয়েছেন, এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না হলে মূল্য চুকাতে হবে।

শুধু ফিকিরতেপের ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা নন, সাধারণভাবে এরদোয়ানের ওপর ক্ষুব্ধ মূল্যস্ফীতির ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষও। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এরদোয়ানের সরকার সরাসরি শস্য কিনছে কৃষকদের কাছ থেকে। তারপর তা বাজারে কম মূল্যে বিক্রি করছে। এতে এড়ানো গেছে ফড়িয়াদের। এরদোয়ান এদেরকে ‘খাদ্য সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের আস্থা ফেরেনি।

সরকারি দোকান থেকে কম মূল্যে সবজি কিনতে কিনতে এসরেফ কোর্কমাজ নামের একজন ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন, ‘আজ আমি এখান থেকে শসা ও টমেটো কিনেছি। কিন্তু আগামী এপ্রিলের পর আর এগুলো থাকবে না। আমি আগেও একে পার্টিকে ভোট দিয়েছি। কিন্তু অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে আর ভোট দেবো না। নাক টিপে ধরে হলেও এবার বিরোধী দলকে ভোট দেবো।’