প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিস্ময়কর পতনের পর সিরিয়াজুড়ে উল্লাস ও উদযাপন শুরু হয়েছে। দামেস্ক ও দেশের অন্যান্য অংশেই শুধু নয়, প্রতিবেশী লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেও আনন্দ উল্লাস দেখা গেছে। অনেক বাস্তুচ্যুত সিরিয়ান বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। রবিবার (৮ ডিসেম্বর) দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেয় সিরিয়ার বিদ্রোহীরা। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় প্রেসিডেন্ট আসাদ ও তার পরিবার।
১৩ বছরের নৃশংস যুদ্ধের পর বিরোধী পক্ষের এই চমকপ্রদ অগ্রগতি সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের অর্ধশতাব্দীর শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। পুরো বিশ্বকেই আসাদ সরকারের পতনকে হতবাক করেছে।
জাতিসংঘ
আসাদ সরকারের পতনের পর বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, সিরিয়ার জনগণ এখন স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ঐতিহাসিক সুযোগ পেয়েছে। সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব, ঐক্য, স্বাধীনতা এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
তিনি বলেন, সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে সেখানকার জনগণ। এ লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত তাদের সঙ্গে কাজ করবেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক কাজা কালাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘আসাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান একটি ইতিবাচক এবং বহু প্রতীক্ষিত অগ্রগতি। এটি তার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া ও ইরানের দুর্বলতাও প্রমাণ করে।
তিনি সিরিয়া ও বৃহত্তর অঞ্চলের সমস্ত গঠনমূলক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
চীন
সিরিয়ার পরিস্থিতির অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে চীন। যত দ্রুত সম্ভব সিরিয়ায় স্থিতিশীলতায় ফিরে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আমরা সংশ্লিষ্ট সিরিয়ান পক্ষগুলোকে আহ্বান জানাই যেন তারা চীনা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
মিসর
সিরিয়ায় সব পক্ষকে রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে মিশর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা গভীর মনোযোগ সহকারে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সিরিয়ার জনগণের প্রতি তাদের সমর্থন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও ঐক্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে মিসর।
ফ্রান্স
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বর্বর শাসনের পতনকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং দেশটির জনগণের প্রতি শান্তির শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেছেন,আমি সিরিয়ার জনগণকে, তাদের সাহস এবং তাদের ধৈর্যকে শ্রদ্ধা জানাই। এই অনিশ্চয়তার মুহূর্তে আমি তাদের প্রতি শান্তি, স্বাধীনতা এবং ঐক্যের শুভেচ্ছা জানাই।
জার্মানি
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস আল-আসাদের পতনকে সুসংবাদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে স্থিতিশীল করতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবকও আল-আসাদের পতনকে সিরিয়ানদের জন্য এক বিশাল স্বস্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ইরান
সিরিয়ার ঐক্য এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে ইরান। এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিরিয়ায় সামরিক সংঘাতের দ্রুত সমাপ্তি, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রতিরোধ এবং সিরিয়ান সমাজের সব অংশের সঙ্গে জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। ইরান ও সিরিয়ার জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।
ইসরায়েল
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আসাদের পতনকে ‘ঐতিহাসিক দিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একে ইরান ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আঘাতের প্রত্যক্ষ ফলাফল বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
ইতালি
ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বলেছেন, সিরিয়ার পরিস্থিতির বিবর্তন উদ্বিগ্ন মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছি আমরা। দামেস্কে আমাদের দূতাবাস এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।
লেবানন
লেবাননের সেনাবাহিনী প্রতিবেশী সিরিয়ার সীমান্তে তাদের উপস্থিতি জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে। নজরদারি ব্যবস্থাও কঠোর করা হয়েছে।
ফিলিপাইন
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে আরও সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে এবং বেসামরিক হতাহত রোধে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে ফিলিপাইন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিরিয়ায় অবস্থানরত ফিলিপিনোদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন ও দামেস্কে ফিলিপাইন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কাতার
আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়াকে বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যেতে দেওয়া উচিত নয় বলে সতর্ক করেছে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।কাতার সিরিয়ার পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষা করে এটিকে বিশৃঙ্খলায় পরিণত হতে বাধা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
রাশিয়া
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে,সিরিয়ার ভূখণ্ডে সংঘাতে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর বাশার আল-আসাদ প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। এসময় তিনি ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে রাশিয়া এই আলোচনায় রাশিয়া অংশগ্রহণ করেনি বলে উল্লেখ করেছে। সিরিয়া ত্যাগ করেছেন বলেও জানানো হয়েছে। তবে তার অবস্থান পরিষ্কার করেনি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, সিরিয়ায় রুশ ঘাঁটিগুলোতে সৈন্যরা উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে, তবে তাদের জন্য তাৎক্ষণিক কোনও হুমকি নেই।
তুরস্ক
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন,সিরিয়ার সরকার ভেঙে পড়েছে এবং দেশটির নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হচ্ছে।
কাতারের দোহা ফোরামে কথা বলার সময় তিনি বলেন, এটি রাতারাতি ঘটেনি। গত ১৩ বছর ধরে দেশটি অস্থিরতা এর জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে দেওয়া উচিত নয় বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেছেন, রাজনৈতিক শূন্যতা কাজে লাগানোর সুযোগ সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে দেওয়া উচিত নয়।
সিরিয়ার ঘটনাবলি রাজনৈতিক ব্যর্থতার এবং সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ার অংশীদার এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে যাতে তারা ঝুঁকি মোকাবেলার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
নিজের ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন,আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন” রাশিয়ার সমর্থন হারানোর পর। কারণ তার রক্ষক রাশিয়া ও ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে তাকে আর রক্ষা করতে আগ্রহী ছিল না।
ইয়েমেন
ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের তথ্যমন্ত্রী মোয়াম্মার আল-ইরিয়ানি এক্সে বলেছেন, “ইয়েমেনিরা তাদের প্রজ্ঞা এবং দৃঢ়তার মাধ্যমে ইরান এবং এর হুথি হাতিয়ারের পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ করতে সক্ষম হবে।
সূত্র: আল জাজিরা