মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রভাব মোকাবিলায় ইরান গড়ে তুলেছিল তাদের কৌশলগত জোট, যা পরিচিত ছিল ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ নামে। গত চার দশকে এই জোট ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার ছিল। কিন্তু সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত ও বিতাড়ন, হিজবুল্লাহর দুর্বল অবস্থা এবং হামাসের যুদ্ধে জর্জরিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই জোট কার্যত ভেঙে পড়ছে।
সিরিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদ বিরোধীদের আক্রমণে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তার শাসনামলে সিরিয়া ইরানের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই দেশ ইরানের অস্ত্র সরবরাহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসেবে কাজ করতো। তবে বিদ্রোহীদের হাতে দামেস্কের পতনের পর এই করিডোর কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইরান বহু বছর ধরে আসাদকে সহায়তা করেছে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে, ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর পরামর্শকরা সিরিয়া ত্যাগ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান বুঝতে পেরেছে যে সামরিকভাবে আসাদকে আর রক্ষা করা সম্ভব নয়।
লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী ইরানের দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘর্ষে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি অভিযানে হিজবুল্লাহর মজুত থাকা ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় ৮০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসরায়েলের হিজবুল্লাহর সঙ্গে অতীতের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের একজন লেবানিজ বিশ্লেষক হানিন ঘাদার বলেছেন, ২০০০ ও ২০০৬ সালের যুদ্ধের কারণে হিজবুল্লাহ ইরানের জন্য একটি সফলতার গল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। হাসান নাসরাল্লাহ ইরানিদের কাছে প্রতিরোধের ‘গুরু’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন এবং তারা তার প্রতি অনেক বিনিয়োগ করেছে।
তিনি আরও বলেন, হিজবুল্লাহ হুথি বা ইরাকি মিলিশিয়াদের তুলনায় অনেক বেশি ইরানি সমর্থন পেয়েছিল।
কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের হামলার বিস্তৃত প্রভাবের কারণে হিজবুল্লাহকে তাদের অনেক যোদ্ধাকে সিরিয়া থেকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিল, যা আসাদের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি দল হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের চাপে তাদের শাসনব্যবস্থাও টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অভিযানে হামাসের শীর্ষ নেতাদের নিশানা করা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ইরানের প্রভাব কমছে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী এবং ইরাকের শিয়া মিলিশিয়ারা এখনও ইরানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িত নয়।
ইরানের জন্য সিরিয়ার পতন কৌশলগতভাবে বড় ধাক্কা। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বিস্তারে এই জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই জোটের আগের শক্তি ফিরে পেতে ইরানের অনেক বছর সময় লাগবে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে দেশটির জনগণের অধিকার রয়েছে। তারা একটি জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। তবে একই সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে জাতিসংঘের পরিদর্শকদের উদ্বেগ বেড়েছে।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ইরান ও তাদের মিত্রদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের সামরিক শক্তি ও আঞ্চলিক মিত্রদের ওপর এই আক্রমণ ইরান যে অপ্রতিরোধ্য, সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হাসান আহমাদিয়ান বলেছেন, এসব ক্ষতির পরও বহু বছর ধরে এই মিত্রতা ইরানের দৃষ্টিতে তার উদ্দেশ্য সফলভাবে পূরণ করেছে। ইরানিরা মনে করতো, এটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধক হবে, অপরাজেয় প্রতিরক্ষা নয়।
তিনি বলেন, ইরান সবসময়ই স্বীকার করেছে যে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি অসম যুদ্ধে লিপ্ত। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত অস্ত্র এবং দৃঢ় রাজনৈতিক সমর্থন ইসরায়েলের পক্ষে রয়েছে। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, যদিও এটি কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ইরানিদের কাছে এই দুটির কোনোটিই নেই। তবে কৌশলটি ছিল পারমাণবিক অস্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের এই ক্ষমতাগুলোকে ভারসাম্যে রাখা—মতাদর্শগতভাবে অনুরূপ সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সরকারগুলোর মিত্রতার মাধ্যমে।
তবে ইরান এখনও পুরোপুরি হার মানেনি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরান দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং তারা তাদের মিত্রদের পুনর্গঠন করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তারা বলছেন, ইরান ও তাদের মিত্ররা এখনও পরাজয় মেনে নেয়নি। তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং আঞ্চলিক কৌশল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখনও হুমকি হয়ে থাকবে।
অভিজ্ঞ ইরান বিশ্লেষকরা এখনই তাদের গুটিয়ে ফেলার সম্ভাবনা নাকচ করতে সতর্ক করেছেন। লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত রায়ান ক্রকার বলেছেন, স্পষ্টতই হিজবুল্লাহ মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়েছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে ইরান দুর্বল শক্তি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছে। কিন্তু, কৌশলগত ও আভিযানিক সাফল্য সবসময় কৌশলগত বিজয়ে রূপান্তরিত হয় না।
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, হিজবুল্লাহ পুরোপুরি পরাজিত হয়নি। আর ইরানও এখনই নিজেদের সীমানার পেছনে সরে আসার সম্ভাবনা নেই। তার মতে, আমি মনে করি না ইরান বা হিজবুল্লাহ নিজেদের এখানে পরাজিত বলে মনে করে। আর ইরান একটি বিষয় প্রমাণ করেছে, তা হলো তারা দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বজায় রাখার ক্ষমতা রাখে।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস