ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও)। কিন্তু সেই নিন্দা জানানো থেকে সরে দাঁড়িয়েছে ভারত। ইসরায়েলের প্রতি নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে এসসিও। তাহলে কেন এসসিওর আলোচনায় অংশ নেয়নি বা বিবৃতিকে সমর্থন করেনি ভারত? ভারত কি ইসরায়েলকে সমর্থন করছে? বিষয়টি ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে শক্তিশালী ইউরেশীয় রাজনৈতিক জোটে মতপার্থক্যেরই ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্ব নেতারা ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলা নিয়ে বারবার উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। শুক্রবার ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর সর্বশেষ লড়াই শুরু হয়। এর আগে ২০২৪ সালে দু’বার ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে জড়ায়, যা ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শেষ হয়।
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এসসিও একটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা জোট। সদস্য দেশগুলো হলো: চীন, বেলারুশ, ভারত, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান। ২০২৩ সালে ভারতের সভাপতিত্বে ইরান এই জোটে যোগ দেয়।
শনিবার এসসিও’র বর্তমান চেয়ারম্যান জানান, তারা ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং ‘ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েল পরিচালিত সামরিক হামলাগুলোর তীব্র নিন্দা’ জানাচ্ছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ‘আক্রমণাত্মক কার্যক্রম, বিশেষ করে বেসামরিক অবকাঠামো যেমন: জ্বালানি ও পরিবহন ব্যবস্থার ওপর হামলা, যা বেসামরিক হতাহত ঘটিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের চরম লঙ্ঘন।’
এতে বলা হয়, এসব হামলা ‘ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর ঝুঁকি।’
বিবৃতিতে ইরানের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলা হয়, পারমাণবিক ইস্যু কেবল শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক পথে সমাধান করতে হবে।
ইসরায়েলের তেহরানে প্রথম হামলার পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। সেখানে তিনি ‘পরিস্থিতির মোড় ঘোরা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তিনি ‘উত্তেজনা এড়াতে ও দ্রুত কূটনৈতিক পথে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।’ ।
পৃথক বিবৃতিতে ভারত জানায়, ‘আমরা পরমাণু স্থাপনা নিয়ে হামলার খবরসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ভারত উভয় দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে এবং প্রয়োজনে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’
ম্যাসাচুসেটস-আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শান্থি ডি’সুজা বলেন, “অন্যান্য এসসিও দেশের চেয়ে ভারতের অবস্থান ব্যতিক্রম, কারণ তাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আছে ইসরায়েলের সঙ্গে, আবার অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে ইরানের সঙ্গে।”
ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা এবং ২০২৪ সালে গাজায় যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় অস্ত্র প্রস্তুতকারীরা ইসরায়েলকে রকেট ও বিস্ফোরক বিক্রি করেছে বলে আল জাজিরার তদন্তে উঠে এসেছে।
একই সময়ে ভারত ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়নে কাজ করছে, যা মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে ভারতের রপ্তানি প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করবে।
প্রশ্ন উঠেছে-ভারত কি ইসরায়েলকে সমর্থন করছে? এসসিওর অবস্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ভারত জোটের সমালোচনার শক্তি কমিয়ে দিয়েছে।
এসসিও বিবৃতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার একদিন আগেই ভারত জাতিসংঘে গাজায় ‘তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত ও স্থায়ী’ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত ছিল।
নিউ দিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কাবির তানেজা বলেন, ভারতের জাতিসংঘে ভোট না দেওয়াটা ‘বিস্ময়কর এবং সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টার অংশ।’
তানেজা বলেন, ‘এসসিওর কাঠামোর মধ্যেই ভারত কিছুটা ব্যতিক্রম, কারণ রাশিয়া ও চীন ইরানের ঘনিষ্ঠ, আর ভারতের সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে। তাই ভারতের পক্ষে এসসিওর কড়া ভাষা সমর্থন করা কঠিন ছিল।’
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে, তেহরান ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্থান হারায়।
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর, ইরানের বিরুদ্ধে চাপ আরও বাড়িয়ে চাবাহার বন্দরের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যা পূর্বে ছাড় দেওয়া হয়েছিল।
এই বন্দর পাকিস্তানকে বাইপাস করে ভারতের জন্য আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সংযোগ তৈরি করে। তবে এখন ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা এটিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
তানেজা বলেন, ভারতের জন্য ইরান শুধুই বন্দর নয়, বরং আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দিকে কৌশলগত প্রবেশদ্বার—যেখানে ভারতের বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও প্রভাব বিস্তারের স্বার্থ জড়িত।
সূত্র: আল জাজিরা