ইরানে যুদ্ধের জেরে ইসরায়েলে রাজনৈতিক স্বস্তিতে নেতানিয়াহু

ইরানে হামলার পর ইসরায়েলের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পার্লামেন্টে পরপর দুটি আস্থা ভোটেই তা স্পষ্ট হয়েছে। যেখানে সপ্তাহখানেক আগেও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কট্টর ডানপন্থি জোট সরকার পতনের মুখে ছিল, এখন সেই নেতানিয়াহুই ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জেরে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে একটুর জন্য বেঁচে যায় নেতানিয়াহুর সরকার। কট্টর ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে শেষ মুহূর্তে সমঝোতা না হলে পার্লামেন্ট ভেঙে গিয়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা আসতে পারত। তবে সপ্তাহের শুরুতে (সোমবার) ইসরায়েলি পার্লামেন্টে যখন আরেকটি অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় তখন তা অত্যন্ত দুর্বলভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। আরব-ইসরায়েলি দলগুলোর আনীত সেই প্রস্তাব মধ্য কিংবা ডানপন্থিদের কোনও সমর্থনই পায়নি।

এর মধ্যবর্তী সময়ে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালায়, যা গোটা দেশেই চমক জাগায়। বিরোধীদলের একাংশ এখন সেই হামলার সমর্থনে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

সোমবারের অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য প্নিনা তামানো-শাতা বলেন, এই প্রস্তাব বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। এখন দেশজুড়ে যুদ্ধ, আর বিরোধীদের এই আচরণ দায়িত্বজ্ঞানহীন।

এই মতামত এখন ইসরায়েলের মূলধারার রাজনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে। এমনকি এক সময় নেতানিয়াহুর প্রবল সমালোচক ছিলেন যেই ইয়ার লাপিদ, সেই তিনিও এখন প্রকাশ্যে ইরানে হামলার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকেও এই যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। হামলার পরদিন তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে একত্রে ছবি তোলেন, পেছনে ইরানের মানচিত্র—যেন এক নতুন যুগের প্রতীক।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ডানপন্থি নেতা নাফতালি বেনেত স্পষ্টভাবেই বলেন, এখন আর ডান বা বাম নেই, বিরোধী বা জোট নেই—সবাই ইরানের বিরুদ্ধে।

তবে সব বিরোধীদল এই অবস্থানে নেই। পার্লামেন্ট সদস্য আইদা তৌমা-সুলেইমান বলেন, নেতানিয়াহুর প্রতিটি সংকটে বিরোধীরা যেভাবে সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তা অবিশ্বাস্য। এরা নিজেকে ‘জায়নবাদী বাম’ বললেও যুদ্ধকে সমর্থন করে। আর যারা প্রশ্ন তোলে, তারা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে ধরেই নেওয়া হয়।

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। গাজা যুদ্ধ নিয়ে বিরক্তি, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থতা, রিজার্ভ সেনাদের অংশগ্রহণে অনীহা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খোলা চিঠি ইত্যাদি নেতানিয়াহুকে প্রবল চাপে ফেলেছিল।

তার ওপর ২০১৯ সাল থেকে চলে আসা দুর্নীতির বিচার এখনও নেতানিয়াহুর পেছনে তাড়া করছে। কিন্তু সেই সব চাপ এখন অন্তত সাময়িকভাবে চাপা পড়ে গেছে ইরানের বিরুদ্ধে ‘পুরোনো যুদ্ধ’ শুরুর মধ্য দিয়ে।

তেলআবিব, হাইফা ও অন্যান্য শহরে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ২৪ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পরও নেতানিয়াহুর প্রতি সমর্থন বাড়ছে। সোমবার প্রকাশিত চ্যানেল ১৪-এর জরিপে তার তুমুল জনপ্রিয়তা দেখানো হয়েছে। প্রায় সব বড় সংবাদমাধ্যম নেতানিয়াহুর অবস্থানের প্রতি সহানুভূতিশীল।

এমনকি টাইমস অব ইসরায়েল দাবি করেছে, ইরান যুদ্ধাপরাধ করছে, যদিও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের পরোয়ানা রয়েছে। গাজায় গণহত্যার অভিযোগে বিচার চলছে আন্তর্জাতিক আদালতেও।যা ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে প্রায় অনুপস্থিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিমরোদ ফ্লাশেনবার্গ বলেন, গত কয়েক দশকের প্রচারণায় নেতানিয়াহু ও তার অনুসারীরা সফলভাবে এই ধারণা তৈরি করেছেন যে ইসরায়েলের সমস্যার মূল শত্রু ইরান, ফিলিস্তিন নয়। এখন এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিকভাবে গৃহীত সত্য হয়ে গেছে।

তবে নেতানিয়াহুর অতীত বলে, তিনি রাজনৈতিকভাবে অনেকবার স্বস্তি পেয়ে আবার সংকটে পড়েছেন। গাজায় যেমন ‘পুরোপুরি বিজয়’ চেয়েছিলেন, তেমনি ইরানের ক্ষেত্রে বলছেন, পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস এবং প্রয়োজনে তেহরানে সরকার পতনের’ লক্ষ্য তার।

ইসরায়েল স্টাডিজের মার্কিন অধ্যাপক ডভ ওয়াক্সম্যান বলেন, যদি এই যুদ্ধ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসে ব্যর্থ হয়, বা নতুন চুক্তির পথে ইরানকে বাধ্য না করতে পারে, তাহলে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ক্ষতি হবে। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে ও হতাহতের সংখ্যা বাড়লে জনমত নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যেতে পারে।

তবে জনমতের পরিবর্তন নেতানিয়াহুর ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা স্পষ্ট নয়। গাজা যুদ্ধেও তিনি মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিদের ব্যাপারে জনমতের চাপে মাথা নত করেননি।

বিশ্লেষক ফ্লাশেনবার্গ বলেন, নেতানিয়াহুর হয়তো কেবল সপ্তাহখানেক সময় আছে জনসমর্থনের। কিন্তু গাজার অভিজ্ঞতা বলছে, তাতেও তার কিছু যায় আসে না। যদি তিনি এটিকে ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ হিসেবে টেনে নিতে চান, সেটাই করবেন। তাকে থামাতে পারে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র।