তুরস্ক কেন ইরানে মার্কিন হামলার সরাসরি নিন্দা জানালো না?

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর অনেক দেশ প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে। কিন্তু তুরস্ক এখন পর্যন্ত সরাসরি নিন্দা জানায়নি। বরং দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে সতর্ক সুরে বলেছে, হামলার পরিণতি হতে পারে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তুরস্কের এমন অবস্থানের নেপথ্যে দেশটি নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে হাজির করার লক্ষ্যের কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই-এর এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা গেছে।

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই হামলা ছিল অসাধারণ এক সামরিক সাফল্য। ইরানের মূল পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। ইরান যদি শান্তি না চায় তাহলে সামনে আরও ভয়াবহ হামলা হবে।

ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা কঠোর ভাষায় জানালেও এবার আঙ্কারা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরিণতিতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা আঞ্চলিক সংঘর্ষকে বৈশ্বিক মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে।

এই বিবৃতির ভাষা ছিল স্পষ্টভাবে সংযত। যা একদিন আগেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের কড়া ভাষার চেয়ে একেবারে বিপরীত। ওই সময় তিনি ইসরায়েলি আগ্রাসনকে ‘ডাকাতির মতো’ বলেছিলেন।

আঙ্কারা দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু সেই সঙ্গে সব সময় কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষেও কথা বলে এসেছে। ২০১০ সালে তুরস্ক ও ব্রাজিল যৌথভাবে একটি পারমাণবিক জ্বালানি বিনিময় চুক্তি করে উত্তেজনা প্রশমনে উদ্যোগ নেয়।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় নীতি বিষয়ক পরামর্শ পরিষদের সদস্য এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুরাত ইয়েসিলতাস বলেন, তুরস্ক ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে।

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাকে তুরস্ক উসকানিমূলক বলে বিবেচনা করছে। বিশেষত যখন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কেউই মনে করছে না যে তেহরান সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করছে।

তুরস্ক দ্রুত যেকোনও ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানায়। বিশেষ করে গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে এই নতুন পর্ব শুরু হওয়াকে ‘বিপজ্জনক ফাটল’ বলেও মন্তব্য করে।

ইরানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা নূর নিউজ জানিয়েছে, ১৩ জুন থেকে ইসরায়েলের হামলায় ইরানে প্রায় ৫০০ জন নিহত ও সাড়ে তিন হাজারের মতো আহত হয়েছে। এর জবাবে ইরানি হামলায় ইসরায়েলে কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে তেলআবিব।

এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একাধিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

এই আলোচনার মধ্য দিয়ে এরদোয়ান নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করছেন এবং ইস্তাম্বুলকে পারমাণবিক আলোচনা আয়োজনের স্থান হিসেবে প্রস্তাব দিয়েছেন।

তুরস্কের কর্মকর্তারা মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছেন, এরদোয়ান ট্রাম্পকে রাজি করিয়েছিলেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং দূত স্টিভ উইটকফকে ইস্তাম্বুলে পাঠাতে। সেখানে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তাদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।

ট্রাম্প এমনকি আলোচনায় নিজে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির অনুমোদন না পাওয়ায় বৈঠকটি আর হয়নি।

তবে তুরস্ক এখনও আলোচনার পথ খোলা রাখতে চায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সংকটের একমাত্র সমাধান আলোচনা। তুরস্ক দায়িত্ব পালন ও গঠনমূলক অবদান রাখতে প্রস্তুত।

আঞ্চলিক সংঘাতে এরদোয়ান প্রায়ই শক্তিশালী বক্তব্য রাখলেও বাস্তবে তিনি নিজেকে ‘দুই পক্ষের মাঝে’ ধরে রাখতে চান। তুরস্কের ন্যাটো সদস্যপদ ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাকে কৌশলগতভাবে বিশেষ সুবিধা দেয়। যা দিয়ে একদিকে যেমন আঞ্চলিক লক্ষ্য অর্জন করা যায়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সমীকরণেও প্রভাব ফেলা যায়।

মুরাত ইয়েসিলতাস বলেন, তুরস্কের অবস্থান স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থের নয়। এই সংঘাত শুধু রাজনৈতিক নয়, তুরস্কের ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক লক্ষ্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি।