ইসরায়েল-ইরান সংঘাত

মধ্যপ্রাচ্যে প্রকাশ্যে এলো চীনা কূটনীতির সীমিত প্রভাব

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার ১২ দিনের সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কূটনৈতিক সক্ষমতা ও প্রভাবের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সংঘাত শুরু হতেই দ্রুত শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছিল চীন। এক দিন পরই ইসরায়েলের হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানান চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও সংঘাত নিরসনের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। চীন রাশিয়া ও পাকিস্তানের সঙ্গে একযোগে কাজ করে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই সক্রিয়তার মধ্যেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ভারসাম্যে চীনের অবস্থান এখনও তুলনামূলক দুর্বল। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে কেবল নতুন উত্তেজনা তৈরি করেনি, বরং বৃহৎ শক্তিগুলোর বাস্তব ক্ষমতারও পর্যালোচনা এনে দিয়েছে। চীন শান্তির আহ্বান জানিয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্বের ইচ্ছা দেখালেও অঞ্চলভিত্তিক প্রভাব, সামরিক অনুপস্থিতি ও দ্বৈত সম্পর্কের বাস্তবতায় তারা এখনও সীমাবদ্ধ ভূমিকায় রয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় চীনের জন্য এগিয়ে যাওয়া যেমন জটিল, তেমনি চুপ করে থাকা আরও ব্যয়বহুল।

কেন উদ্বিগ্ন ছিল চীন?

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষক ইভানজেলিন চেং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো আদর্শভিত্তিক নয়, চীন বরং কৌশলগত বাস্তববাদ দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে। তাদের প্রধান লক্ষ্য অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা।

মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রয়েছে। ইসরায়েলের প্রযুক্তি খাতে আর ইরান, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, ইরাক, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে অবকাঠামোগত অংশীদারত্ব। তেল আমদানির দিক থেকেও মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি মোট অপরিশোধিত তেলের অর্ধেকের বেশি এখান থেকে আমদানি করে।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইরানি স্টাডিজ বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আলাম সালেহ বলেন, যুদ্ধ ও নিরাপত্তা সংকট শুধু বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নয়, বরং বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য এবং সরবরাহের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। চীন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায় এবং সামরিক সমাধান বরাবরই তারা প্রত্যাখ্যান করে।

চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জন গং জানান, চীনের প্রধান উদ্বেগ ছিল জ্বালানির দামে ব্যাপক অস্থিরতা। তিনি বলেন, তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেলে জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

কূটনৈতিক চেষ্টার সীমাবদ্ধতা

ইরানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা ও চীনের অর্থনৈতিক উদ্বেগকে বিবেচনায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সম্প্রতি বেইজিংকে আহ্বান জানান যেন তারা ইরানকে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে নিরুৎসাহিত করে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বেইজিংয়ের সাময়িক কূটনৈতিক প্রভাবের স্বীকৃতি হলেও সামগ্রিকভাবে চীনের ‘সুবিধা আদায়’ এখনও সীমিত।

চেং বলেন, চীন শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে এগিয়ে এসে দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে চাইলেও তাদের হাতে কার্যকর প্রভাব খুবই কম। সামরিক সক্ষমতা না থাকা, রাজনৈতিক প্রভাবের ঘাটতি এবং ইসরায়েলের সঙ্গে অবিশ্বাসের সম্পর্ক, সব মিলিয়ে চীন বাস্তবতায় সীমাবদ্ধ।

তবে চীন এর আগেও কৌশলগত সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ে হামাস ও ফাতাহর মধ্যে গাজা শাসন কাঠামো নিয়ে ঐকমত্য হয় চীনের সহায়তায়। যদিও এসব ক্ষেত্রে ওমান ও ইরাকের সহযোগিতা চীনের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়।

চীনের বিপরীত বাস্তবতা

ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর উত্তর-পূর্ব এশিয়া বিশ্লেষক উইলিয়াম ইয়াং বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা এবং ইরানের সঙ্গে চীনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চুক্তি—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বই বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে তুলেছে।

২০২১ সালে চীন ও ইরান ২৫ বছরের কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি করে এবং ইরান বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ইরান সম্প্রতি চীনের নৌ-মহড়াতেও অংশ নেয়। এই পারস্পরিক অংশীদারত্ব ইসরায়েলের আস্থাহীনতা আরও বাড়িয়ে তোলে।

ইয়াং বলেন, চীন একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে শান্তি প্রতিষ্ঠার সক্ষমতা অর্জন করতে চাইলেও সংকটে অংশ নেওয়া পক্ষগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে সেই সক্ষমতা হ্রাস পায়।

নিরাপত্তা আমেরিকার, নৈতিক উচ্চতা চীনের

ইয়াং বলেন, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তার প্রধান গ্যারান্টর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই টিকে থাকবে এবং চীন এ ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায়।

তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা চীনকে নৈতিক উচ্চতা পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেখানে চীন আরও সংযত, দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান তুলে ধরছে।