গত অক্টোবরে মেয়র পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করার সময় জোহরান মামদানি ছিলেন নিউ ইয়র্ক সিটির অধিকাংশ বাসিন্দার কাছেই অপরিচিত এক রাজ্য আইনপ্রণেতা। কিন্তু মঙ্গলবার (২৪ জুন) সন্ধ্যায় ৩৩ বছর বয়সী মামদানি রাজনীতিতে তার বিস্ময়কর উত্থান উদযাপন করেন। কারণ নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদের প্রাথমিক নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন জোহরান মামদানি। নিউ ইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো পরাজয় স্বীকার করার পর, তিনি কুইন্সের একটি রুফটপ বারে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
যদিও এই র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং অনুযায়ী, চূড়ান্ত ফলাফল ১ জুলাই প্রকাশিত হওয়ার কথা। তবু এখানে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কে এই জোহরান মামদানি, যিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ৪০০ বছরের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়র হতে চলেছেন। এছাড়া কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী মেয়রও হতে যাচ্ছেন তিনি।
কে এই মামদানি?
জোহরান মামদানি জন্মগ্রহণ করেন উগান্ডার কামপালায়। তিনি শৈশবে পরিবারসহ কিছু দিন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনেও ছিলেন। এরপর ৭ বছর বয়সে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটিতে চলে আসেন। তিনি কলেজ থেকে স্নাতক করার পর ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ও পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার তার মা। মীরা নায়ারের বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে মুনসুন ওয়েডিং, দ্য নেমসেক, মিসিসিপি মাসালা অন্যতম। তার বাবা মাহমুদ মামদানি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তিনি আলোচিত ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম’ বইয়ের লেখক।
মামদানি এ বছর ২৭ বছর বয়সী সিরিয়ান-আমেরিকান শিল্পী রামা দুয়াজির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতি ডেটিং অ্যাপ ‘হিঞ্জে’ পরিচিত হন। রামার কাজ দ্য নিউইয়র্কার, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও ভাইস-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছে। তারা কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়া এলাকায় বসবাস করেন।
মামদানি নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস হাইস্কুল অব সায়েন্সে পড়াশোনা করেছেন। ওই পাবলিক স্কুলে প্রথম ক্রিকেট দল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ২০১৪ সালে তিনি মেইনের বোডিন কলেজ থেকে আফ্রিকান স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজে থাকাকালীন তিনি স্টুডেন্ট ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন চ্যাপ্টারও প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি কম আয়ের পরিবারের বাসাবাড়ি হারানো ঠেকাতে 'হাউজিং কাউন্সেলর' হিসেবে কাজ করতেন। এই কাজটিই তাকে রাজনীতিতে আসতে অনুপ্রাণিত করে।
২০১৯ সালে তার দাদির স্মরণে বানানো গান ন্যানি তার মেয়র নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হওয়ার পর নতুন জীবন পায় এবং অনেক বিস্তৃত শ্রোতার কাছে পৌঁছে যায়।
অন্যদিকে তার ২০১৭ সালের গান সালামে তিনি নিউ ইয়র্কে মুসলিম হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অবশ্য সেই গান থেকে উদ্ধৃত করে সমালোচকরা বলেন, তার মতামত নিউ ইয়র্কারদের জন্য খুবই চরমপন্থি।
রাজনীতিতে শুরুর দিনগুলো
২০২০ সালে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির ৩৬ নম্বর আসন থেকে নির্বাচিত হন মামদানি। তিনি কুইন্সের আস্টোরিয়া আশপাশের এলাকাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। দীর্ঘদিনের এক ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীকে পরাজিত করার পর তিনি দুইবার সহজেই পুনর্নির্বাচিত হন।
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে মামদানির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইন প্রস্তাব হলো একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা — যেখানে শহরের কয়েকটি ‘বাস’ এক বছরের জন্য বিনামূল্যে চলেছে। এছাড়াও তিনি একটি বিল উত্থাপন করেন, যেখানে বেসরকারি অলাভজনক সংস্থাগুলোর ‘ইসরায়েলি বসতি স্থাপন কার্যক্রমে অনুমোদনহীন সহায়তা’ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
মামদানির বিরোধীরা, বিশেষ করে কুয়োমো, তাকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর পরিচালনার জন্য অযোগ্য বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে মামদানি এই তুলনামূলক অভিজ্ঞতার অভাবকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করেন। মেয়র প্রার্থীদের বিতর্কে তিনি বলেন, তিনি ‘গর্বিত’ যে তার কুয়োমোর মতো ‘দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি ও লজ্জার অভিজ্ঞতা’ নেই।
মামদানি বলিউড ও তার ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ রসবোধের ভিডিও বানিয়ে কুইন্সের বাইরের ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। প্রচারণার শেষদিকে তিনি ম্যানহাটনের রাস্তায় প্রায় ২১ কিলোমিটার হাঁটেন এবং পথিমধ্যে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আলাপের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেন। টিকটক ভিডিওতে তিনি রঙিন বর্ণের ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে স্প্যানিশ, বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় কথা বলেছেন।
প্রগতিশীল প্রতিশ্রুতি
মামদানির প্রচারণায় ছিল আশাবাদী এক দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে কুয়োমোর মতো প্রতিদ্বন্দ্বীরা অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা নিয়েই বেশি ফোকাস করেছেন।
তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সাধারণ নিউ ইয়র্কবাসীর জন্য জীবনযাত্রার খরচ কমানোর নানা পদক্ষেপ— যেমন: বিনামূল্যে চাইল্ড কেয়ার, ফ্রি বাস, ভর্তুকিপ্রাপ্ত অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারীদের জন্য ভাড়া স্থির রাখা এবং নতুন সাশ্রয়ী বাসস্থান তৈরি— যার অর্থ আসবে ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর মাধ্যমে।
এই বড় প্রতিশ্রুতিগুলো ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উদারপন্থি অংশে তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তিনি নিউ ইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ ও ভেরমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের মতো প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বদের সমর্থন পেয়েছেন।
ফিলিস্তিনপন্থি মতাদর্শ
ফিলিস্তিনকে ঘিরে মামদানির স্পষ্ট অবস্থান ছিল মেয়র নির্বাচনের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়। কুয়োমো ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা তার ইসরায়েলবিরোধী মন্তব্যকে ইহুদিবিরোধী বলে তুলে ধরেন। শিয়া মুসলিম মামদানি গাজার ওপর ইসরায়েলি হামলাকে ‘গণহত্যা’ বলেছেন। ইসরায়েলকে ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ নয়, ‘সমান অধিকারের রাষ্ট্র’ হিসেবে থাকার কথা বলেছেন। তার এই বক্তব্য নিউ ইয়র্কের ফিলিস্তিনপন্থি ও প্রায় ৮ লাখ মুসলমানের মধ্যে গভীরভাবে সাড়া ফেলেছে।
মঙ্গলবার বিজয় ভাষণে মামদানি প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তার বিশ্বাস ত্যাগ করবেন না। তবে যাদের সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে কাজ করতেও প্রস্তুত থাকবেন।
মামদানি বলেন, আমি আমার বিশ্বাস বা অঙ্গীকার পরিত্যাগ করবো না। কারণ তা সমতা ও মানবতার দাবি থেকে উৎসারিত। তবে যাদের সঙ্গে আমি একমত নই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে চেষ্টা করবো এবং সেই মতপার্থক্যগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে লড়বো।
এ বছরের ৪ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক সিটির সাধারণ মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া। তিনি ২০২১ সালের নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন। প্রাইমারির চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর মামদানি আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হবেন।
সূত্র: এপি