জাতিসংঘের সাইবার আলোচনায় ‘স্নায়ুযুদ্ধের অবিশ্বাসী ছায়া’র আছর

3112স্নায়ুযুদ্ধকালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা যে অবস্থান নিয়েছিলেন, তা আবরও সামনে এসেছে জাতিসংঘের সাইবার যুদ্ধ সীমিতকরণ সংক্রান্ত এক আলোচনায়। ‘স্নায়ুযুদ্ধের অবিশ্বাসী ছায়া’র আছরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আলোচনাটি জুন মাসে ভেস্তে গেছে বলে জানিয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান।

২০০৪ সালে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো দাঁড় করানো নিয়ে এই আলোচনা শুরু হয়। যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যসহ ২৫টি দেশের বিশেষজ্ঞরা এই আলোচনায় অংশ নেন। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক দলের ন্যাশনাল কমিটির কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের ঘটনায় সাইবার হামলা নিয়ে নতুন করে অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। এরপর  জুন মাসে জাতিসংঘের কূটনীতিকরা এই আলোচনায় অগ্রগতির বিষয়ে আশা ছেড়ে দেন। সাইবার হামলায় নিজ দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধই এক্ষেত্রে প্রধান কারণ।

এর আগের অধিবেশনে কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক আইন সাইবার জগতের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের নীতির বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল জাতিসংঘের চার্টারও। ওই চার্টারের ৫১ ধারায় বলা হয়েছে, সশস্ত্র হামলা মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নিজস্ব প্রতিরক্ষার অধিকারকে লঙ্ঘণ করবে না।

কিউবার প্রতিনিধি মিগুয়েল রদ্রিগুয়েজ আলোচনার চূড়ান্ত বৈঠকে জানান, সাইবার জগতে নিজস্ব প্রতিরক্ষার বিষয়টির কারণে এই ক্ষেত্রে সামরিকায়ন ঘটাবে এবং একপাক্ষিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপকে বৈধতা দেবে। এর মধ্যে থাকতে পারে নিষেধাজ্ঞা এবং  হ্যাকিংয়ের শিকার দেশগুলো সামরিক পদক্ষেপও নিতে পারে।

জাতিসংঘের গ্রুপ অব গভর্নমেন্টাল এক্সপার্ট-এ (জিজিই) যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাইকেল মার্কফ। রাশিয়া ও চীনের নাম উল্লেখ না করে তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন,  আন্তর্জাতিক আইনের বিধান ও নীতি বাস্তবায়নে কয়েকটি দেশ একমত না হওয়ায় এই আলোচনা ভেস্তে গেছে।

মার্কফ বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, এই দেশগুলো মনে করে সাইবার জগতে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কোনও সীমা ও তাদের পদক্ষেপের কোনও সীমাবদ্ধতা থাকবে না। এক্ষেত্রে দেশগুলো একেবারে মুক্ত থাকবে। এটি বিপজ্জনক ও অসমর্থনযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি।

আলোচনাটি ভেস্তে যাওয়ার পর ইসরায়েলের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে একটি সম্মেলনে রাশিয়ার সিনিয়র কর্মকর্তা ওলেগ খ্রামভ আলোচনাটি ভেস্তে যাওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, তথ্য জগতে আচরণের নিয়ম গ্রহণ করতে আমাদের আরও আলোচনা প্রয়োজন। আমরা সবাই নিজেদের অনেক পেছনে নিয়ে যাচ্ছি।

এক্সেটার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক ও মার্কিন বিমানবাহিনীর সাবেক আইনজীবী মাইক স্মিথ জাতিসংঘের জিজিই আলোচনাটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন শুরু থেকেই। তিনি জানান, মস্কো ও বেইজিং হিসেবে কষে দেখেছে সাইবার হামলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ার কোনও নিশ্চয়তা যদি থাকে না তাহলে পশ্চিমাদেরই ক্ষতি হবে।

মাইক জাস্ট সিকিউরিটি ব্লগে লিখেছেন, সাইবার জগতের লড়াইয়ে পশ্চিমারা ছড়ি ঘুরাবে এই উপলব্ধি হয়ত এড়াতে চায় (রাশিয়া, চীন ও কিউবা)। অথবা তারা যেসব সাইবার অভিযান চালাচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে যাতে পশ্চিমারা আইনিভাবে জবাব দিতে না পারে সেই ব্যবস্থা রাখা।

পুরো আলোচনায় বিরোধের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল বিদেশি সাইবার হামলার ক্ষেত্রে কোনও দেশ দায়ী তা নির্ধারণের বিষয়। এছাড়া হ্যাকারদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, বিষয়টি প্রমাণ করা অনেক কঠিন। বিশেষ করে যেসব দেশের হামলাকারীদের চিহ্নিত করার মতো কারিগরি দক্ষতা নেই।

সাইবার যুদ্ধ নিয়ে আইনি বিরোধটি ড্রোন মোতায়েন নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়টির মতোই। উভয় প্রযুক্তিই রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে পরিচালনা করা যায়।

স্মিথ বলেন, পশ্চিমা দৃষ্টিকোন থেকে রাশিয়া ও চীন নিয়ে তারা বেশি উদ্বিগ্ন। ডেমোক্র্যাটদের কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের ঘটনায় রাশিয়াকে দায়ী করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সিদ্ধান্তকে আমি সমর্থন করি। অনেক দেশই আইনি অস্পষ্টতা পছন্দ করে। কারণ এতে তারা সুবিধা পায়। আইন ভঙ্গের অভিযোগে কোনও শাস্তির ঝুঁকি ছাড়াই তারা পদক্ষেপ নিতে পারে। তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে হয়ত আইনটি সহায়ক না। জিজিই নিয়ে কোনও অধিবেশন সূচিতে নেই। তবে এখন করণীয় নিয়ে আলোচনা  হবে। সূত্র: গার্ডিয়ান।