ট্রাম্প সমর্থকদের লক্ষ্যবস্তু এবার বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠান

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে নজিরবিহীন তাণ্ডবের পরও থেমে নেই ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের কর্মকাণ্ড। অনলাইনে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এমনকি ২০ জানুয়ারি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকেও লক্ষ্যবস্তু করার পরিকল্পনা চলছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক বিশ্লেষণে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ক্যাপিটল হিলে হামলার পর নিজেদেরকে আরও বেশি বলিষ্ঠ ভাবতে শুরু করেছে চরমপন্থী সংগঠনগুলো। তাদের কণ্ঠে জোরালো হচ্ছে সহিংসতার আহ্বান।

৬ জানুয়ারি (বুধবার) যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে তাণ্ডব চালানোর কয়েক সপ্তাহ, কয়েক দিন এমনকি কয়েক ঘণ্টা আগেও ট্রাম্প সমর্থকদের পক্ষ থেকে দেওয়া বিভিন্ন সতর্ক বার্তা ছিল চোখে পড়ার মতো। ঘৃণাবাদী ও উগ্র ডানপন্থী সংগঠনগুলোকে দেখা গেছে তারা অনলাইনে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে গৃহযুদ্ধের ডাক দিচ্ছিলো, শীর্ষ আইনপ্রণেতাদের মৃত্যু কামনা করছিলো এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার কথা বলছিলো। তাদের কয়েকটি পোস্ট ছিল এমন- ‘হয় ট্রাম্প, নয়তো যুদ্ধ, ব্যস, এটাই সোজাসুজি কথা।’ ‘কিভাবে গুলি করতে হয়, তা যদি আপনারা না জানেন তবে আপনাদেরকে শিখে নিতে হবে। এখনই।’ ‘আমরা সরকারি ভবনগুলোতে হামলা চালাব, পুলিশকে মেরে ফেলব, নিরাপত্তারক্ষীদের মারব, কেন্দ্রীয় কর্মী ও এজেন্টদের হত্যা করব এবং ভোট পুনর্গণনার দাবি জানাব।’

এরপর ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায় ট্রাম্প সমর্থকরা। পুলিশের সঙ্গে তাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রাণ হারায় ৫ জন। তবে এটাই শেষ নয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের দিনকে সামনে রেখে সহিংস এ আহ্বানের এতটুকু কমতি ঘটেনি, বরং তা আরও জোরালো হচ্ছে।

বিদ্বেষমুলক বক্তব্য শনাক্ত করে তা ঠেকানোর কাজ করে এন্টি ডিফেমেশন লিগ। প্রতিষ্ঠানটির সিই্ও জোনাথন গ্রিনব্লাট বলেন, ‘আমরা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ও চরম ডানপন্থী উগ্রবাদীদের কাছ থেকে এসব বক্তব্য দেখতে পাচ্ছি। তারা এ মুহূর্তে নিজেদেরকে শক্তিশালী মনে করছে। আমাদের আশঙ্কা, সহিংস এ পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাওয়ার আগে তা আরও বাজে রূপ ধারণ করতে পারে।’

১৮১৪ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ক্যাপিটল হিলে হামলা চালিয়েছিল। এরপর গত ৬ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত এমন ঘটনা দেখা যায়নি। এদিন বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড ভেঙেছে, পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ক্যাপিটল হিল ভবনে তাণ্ডব চালিয়েছে তারা। বিক্ষোভকারীদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রাম্প আহ্বান জানাচ্ছিলেন ঠিকই, তবে নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার মিথ্যা দাবিতে অটল থাকতে দেখা গেছে তাকে। এদিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও সিনেট মেজরিটি নেতা মিচ ম্যাককনেলসহ অন্য রিপাবলিকান নেতারা কঠোরভাবে সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছেন। তবে উগ্র ডানপন্থী ট্রাম্প সমর্থকদের ওপর তার কোনও প্রভাব পড়েনি বললেই চলে।

ক্যাপিটল হিলে হামলার পরদিন বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) ট্রাম্পপন্থী অনলাইন ফোরাম ডোনাল্ড.উইন-এ একজন লিখেছেন: ‘২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেবেন ট্রাম্প। আমরা অবশ্যই কমিউনিস্টদের জিততে দেব না। এর জন্য যদি ডিসিকে জ্বালিয়ে দিতে হয় তবে আমরা তাই করব। আগামীকাল আমরা ডিসির নিয়ন্ত্রণ, আমাদের দেশের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেব।’

এমন অবস্থায় বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান নিয়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাব থেকে সাইবার সিকিউরিটি পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। জ্যেষ্ঠ গবেষক জন স্কট রেইলটন সিএনএন-কে বলেন, শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি ‘ভয়ঙ্কর রকমের উদ্বিগ্ন’। তার মতে, ‘এক দিকে জনসাধারণের একটা বড় অংশ যখন ক্যাপিটলে বুধবারের ঘটনা নিয়ে বিস্মিত, তখন ডানপন্থীদের একটা অংশ একে দেখছিলো সাফল্য হিসেবে।’

রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট অ্যালি আলেক্সান্ডার ট্রাম্পপন্থী সমাবেশ আয়োজন করে থাকেন। বুধবার (৬ জানুয়ারি) ক্যাপিটলের লনে একটি বিক্ষোভের আয়োজকও তিনি। আলেক্সান্ডার অভিযোগ করে বলেন, ‘বামপন্থীরা আমাদেরকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’

ডিসেম্বরের শেষের দিকে পেরিস্কোপে আলেক্সান্ডার অনুসারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, তিনি এবং তিনজন জিওপি কংগ্রেসম্যান (অ্যারিজোনার প্রতিনিধি পল গোসার ও অ্যান্ডি বিগস এবং আলাবামার প্রতিনিধি মো ব্রুকস) মিলে বড় ধরনের কিছু পরিকল্পনা করছেন। ‘

সিএনএন ওই তিন কংগ্রেসম্যানের সবার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। তবে বিগস ছাড়া কারও কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বিগস-এর মুখপাত্রের দেওয়া এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে এ কংগ্রেসম্যান আলেক্সান্ডার কিংবা অন্য কোনও বিক্ষোভকারীর সঙ্গে কোনও কাজে যুক্ত ছিলেন না।

অনলাইনে চরমপন্থী কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণকারী বেশ কয়েকটি সংগঠনও ক্যাপিটল হিলের ঘটনার আগে থেকে সতর্কবার্তা দিয়েছিল। এডিএল নামে এমন একটি সংগঠন ৪ জানুয়ারি একটি দীর্ঘ ব্লগ পোস্ট প্রকাশ করেছিল। সেখানে সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ে শঙ্কা জানানো হয়েছিল। এডিএল এর ব্লগ পোস্ট থেকে জানা গেছে- অনলাইনে এক ব্যক্তি লিখেছিলেন যে ট্রাম্পের নির্বাচনে জয়লাভের দাবির পক্ষে যেসব প্রমাণ সরবরাহ করা হবে তা যদি কংগ্রেস উপেক্ষা করে তখন কী হবে? এর জবাবে একজন লিখেছেন ‘ক্যাপিটলে তাণ্ডব চলবে’।

৪ জানুয়ারিতে সিকিউরিটি ফার্ম জিফোরএস প্রকাশিত এক বিশ্লেষণেও সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ৬ জানুয়ারি ও প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপসহ কারও কারও মধ্যে সহিংস কর্মকাণ্ড চালানোর ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে। ওই বিশ্লেষণে বলা হয়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ডানপন্থী সাইট ডোনাল্ড.উইন সহিংসতায় উসকানিমূলক অনেক পোস্ট লক্ষ্য করা গেছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে এমন একটি পোস্টে বলা হয়, ‘আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কংগ্রেসে তাণ্ডব চালানো ও কংগ্রেস দখলের মতো প্রকৃত কৌশলগত জয় আমাদেরকে অর্জন করতে হবে।’

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কম সক্রিয়তা দেখে অবাক হয়েছেন। লন্ডনভিত্তিক কন্ট্রোল রিস্ক এর বৈশ্বিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ বিষয়ক পরিচালক জোনাথন উড বলেন, ‘নিরাপত্তা ঘাটতি ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি দেখে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকই অবাক হয়েছেন।’

তবে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দাবি, এমন পরিস্থিতি হতে পারে বলে তাদের জানা ছিল না। বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসি পুলিশ প্রধান রবার্ট কন্টি বলেন, ‘কোনও গোয়েন্দা সংস্থাই ইউএস ক্যাপিটলে ভাঙচুর হওয়ার কথা আগাম জানাতে পারেনি।’