ভিয়েতনামে ট্রাম্প-কিম সম্মেলনের নেপথ্যে

ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের মধ্যে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আসলে কী ঘটেছিল? কিংবা এর নেপথ্যেই বা কী ছিল? পাঠকের এমন কৌতুহলের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ওই ব্যর্থ সম্মেলনের কিছু নথি খুঁজে বের করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স। সংশ্লিষ্ট নথিগুলো থেকে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া গেছে। সম্মেলনে ট্রাম্প একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিলেন কিমের হাতে। ইংরেজি ও কোরীয় ভাষায় লিখিত ওই দাবিনামায় পারমাণবিক অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়াও আরও বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। সম্মেলনটি কোনও সমঝোতার ঘোষণা ছাড়াই শেষ হয়। এমনকি বাতিল হয়েছিল পূর্বনির্ধারিত নৈশভোজও। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘লিবিয়া মডেল’ অনুসরণে উত্তর কোরিয়াকে এভাবে পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগের শর্ত মেনে নেওয়ার চাপ দেওয়াটা কিম জং উনের কাছে অপমানজনক হয়ে দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক।s2.reutersmedia.net ২০১৮ সালের জুন মাসে সিঙ্গাপুরে ট্রাম্প-কিম ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে কোরিয়া উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা চুক্তি। তবে নিরস্ত্রীকরণের রূপরেখা সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে দর কষাকষি চলছে। এ বছরের শুরু থেকে ট্রাম্প বেশ কয়েকবার কিমের সঙ্গে নতুন বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভিয়েতনামে শুরু হয় ট্রাম্প ও কিমের দুই দিনব্যাপী বৈঠক। কিন্তু কোনও সমঝোতা ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়।
যে কাগজটি ট্রাম্প দিয়েছিলেন তার বিষয়ে প্রথম জানা গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের কাছ থেকে। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া উভয় পক্ষই সম্মেলনের বিস্তারিত কোনও তথ্য দেওয়া থেকে বিরত ছিল। পরে জন বোল্টন মার্কিন টেলিভিশনে চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র উত্তর কোরিয়াকে দেওয়ার কথা জানালেও ব্যাখ্যা করেননি, তাতে কি লেখা ছিল। তবে এবার সেই নথি হাতে পেয়েছে রয়টার্স।
ওই নথি অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়াতেও ‘লিবিয়া মডেল’ অনুসরণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। বোল্টন অনেক আগে থেকেই উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে ‘লিবিয়া মডেল’ অনুসরণের প্রস্তাব করে আসছেন। ২০০৩ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতনের ঘটনায় ভীত হয়ে পড়েছিলেন লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তিনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণা সংক্রান্ত সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। চাপে রেখে এভাবে পারমাণবিক গবেষণা বন্ধে বাধ্য করার প্রক্রিয়া পরে ‘লিবিয়া মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়। বোল্টন মনে করেন, পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ না করা পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ ও আন্তর্জাতিক চাপ বলবৎ রাখা উচিত।
পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণা বাতিল করেও অবশ্য রক্ষা হয়নি মুয়াম্মর গাদ্দাফির। মাত্র সাত বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর নেতৃত্বে লিবিয়ায় হামলা চালানো হয়। এতে গাদ্দাফি সরকারের পতন ঘটে।
কিমকে দেওয়া ট্রাম্পের দাবিনামায় লেখা হয়েছিল, ‘উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক গবেষণা সংক্রান্ত সব অবকাঠামো, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র গবেষণা বন্ধ করে দিতে হবে। এমনকি অস্ত্র ব্যতীত এসব গবেষণার যদি অন্য কোনও অন্য কোনও লক্ষ্য থেকে থাকে তাহলে সেগুলোও বন্ধ করে দিতে হবে। থামাতে হবে ক্ষেপণাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ এবং এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য প্রকল্প। এসবের পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণায় এতদিন ধরে ব্যবহৃত স্থানগুলো আন্তর্জাতিক ও যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এসব গবেষণায় যুক্ত বিজ্ঞানীদের নিয়োজিত করতে হবে বাণিজ্যিক পণ্য গবেষণায়।
রয়টার্স লিখেছে, উত্তর কোরিয়া বারবার সমালোচনা করেছে যে লিবিয়া মডেলের, সম্মেলনে তার হুমকি পেয়ে কিম জং উন হয়তো অপমানিতবোধ করেছেন। বিশ্লেষকদের চোখে এটি উসকানিমূলকও। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের গবেষক জেনি টাউন বলেছেন, ‘এটাই বোল্টন শুরু থেকে প্রত্যাশা করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র যদি আলোচনার বিষয়ে আসলেই নিষ্ঠাবান হতো তাহলে তাদের এতদিনে বুঝে যাওয়া উচিত ছিল যে, এসব দাবি উপস্থাপন সংলাপ এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। এমন দাবি আগেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বারবার একই দাবি উত্থাপন করলে তা অপমানজনক হিসেবেই গণ্য হওয়ার কথা।’