ইনফেকটেড বার্ন ইউনিটই ইনফেকশনের উৎস!

হাসপাতালের বারান্দায় রোগীরা`ডান হাতের একটি ছোট্ট সমস্যার কারণে গত ৯ দিন ধরে আমি এখানে আছি। সার্জারি করতে হবে। কিন্তু এখানে যেসব পুড়ে যাওয়া রোগী রয়েছেন, তাদের ইনফেকশনে অন্য রোগীরাও ইনফেকটেড হচ্ছি। একজন পোড়া রোগীর ইনফেকশন আরেকজনেও সংক্রমিত হচ্ছে।’ এভাবে নিজের  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পরিবেশের বর্ণনা দিচ্ছিলেন চিকিৎসা নিতে আসা মফিজুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, ‘রোগীদের কথা কী বলব, হাসপাতালের অবস্থাটাই দেখুন। পুরো হাসপাতালের যে স্থানটাতে সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার কথা, যেখানে ইনফেকশনের জন্ম দিচ্ছে। আর কে না জানে বার্ন রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ যেকোনও ধরনের ইনফেকশন।’

মফিজুল ইসলামের কথামতো পুরো বার্ন ইউনিট ঘুরে দেখতেই তার কথার সত্যতা পাওয়া গেল। এই ইউনিটের দ্বিতীয়তলা থেকে পুরো পাঁচতলা পর্যন্ত রোগীরা কেবিন, ওয়ার্ড ছাড়াও বারান্দার মেঝেয় আশ্রয় নিয়েছেন, কারও কারও ঠাঁই হয়েছে বাথরুমের পাশে-সামনে, ড্রেসিং কক্ষের পাশেও বিছানা পেতেছেন অনেকে। কেউবা আবার সিঁড়ির সামনের খোলা জায়গায়। বারান্দায় ঝুলছে রোগী আর স্বজনদের মেলে দেওয়া কাপড়। আর এসব জায়গা থেকেই পুড়ে যাওয়া এসব রোগীর শরীরে বাসা বাঁধছে নানারকম জিবাণু।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বার্ন ইউনিটের বারান্দায় গায়ে গায়ে লেগে রয়েছেন রোগীরা। সেখানে গুরুতর আহত যেমন রয়েছেন, তেমনি কম আহত রোগীরাও রয়েছেন সেখানে। রোগীদের পাশেই রয়েছে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন, ডাবের খোসা, কমলার খোসা, পানের পিক, থুথু, বাসি-পচা খাবার, নোংরা কাপড়, ফেলে দেওয়া ওষুধের বোতল, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, চিপসের খোসা, প্লাস্টিকের ব্যাগ, পলিথিন, ড্রেসিং করার পরের কাপড়, রক্তযুক্ত গজ-ব্যান্ডেজ নানাকিছু। অথচ এসবই জীবাণু জন্মানোর অন্যতম সব উৎস। এখান থেকে জন্মানো জীবানু এসব পোড়া রোগীদের শরীরের ইনফেকশনের সৃষ্টি করে। এমনকি বাথরুম থেকে বেরিয়ে রোগীরা সেই জুতো, স্যান্ডেল নিয়ে বসছেন রোগীর বিছানায়, খাবারও খাচ্ছেন সেখানে বসেই।  

খোলা ডাস্টবিন রোগীদের পাশেই

বৈদ্যুতিক তারে গুরুতর আহত হয়ে সিলেট থেকে এসেছেন মিথুন। তার মা মনোয়ারা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে বাথরুমে যাওয়া যায় না। নাকে কাপড় দিয়ে, চোখ বন্ধ করে যেতে হয়। আর বাথরুমের সামনেই রয়েছে ভেজা একটি পাপস, সেখান থেকে পা মুছে সবাই যাচ্ছে নিজ নিজ বেডে। অথচ ওই ওই পাপস কত বছরের পুরোনো, সেখানে কত হাজার জীবাণু রয়েছে। আর সেখান থেকেই আমরা জীবাণু নিয়ে আসছি সঙ্গে করে।’

মনোয়ারা খাতুন আরও বলেন, ‘ড্রেসিং রুম থেকে ড্রেসিং করার পর সেগুলো রাখা হচ্ছে পাশের খোলা ডাস্টবিনে। অথচ এখান থেকেই জন্ম নিচ্ছে জীবাণু, ছড়িয়ে পড়ছে পোড়া রোগীদের শরীরে।’

বার্ন ইউনিটের জানালার কার্নিশ

বার্ন রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ইনফেকশন। বার্ন ইউনিটও এর বাইরে নয় স্বীকার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে রোগীর চাপ অনেক বেশি। ৩০০ বেডের ইউনিটে এখন প্রায় সাড়ে চারশোর বেশি রোগী ভর্তি। আর প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন আরও বেশি। সে তুলনায় আমাদের জনশক্তি নেই, চিকিৎসক ছাড়া অন্য সব বিভাগে আমাদের জনশক্তির বিশাল ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া প্রতিরোগীর সঙ্গে একজন করে অ্যাটেনডেন্ট থাকার নিয়ম থাকলেও কোথাও দু’জন আবার কারও সঙ্গে তিনজন করেও থাকছেন। এত চাপ সামলে সব সময় সবকিছু ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। এজন্যই বার্ন রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার জন্য একটি পৃথক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যেখানে  একসঙ্গে ৫০০ বেড থাকবে, থাকবে তাদের চিকিৎসার্থে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা।’

রোগীদের বিছানার নিচে খাবার ও গজ ব্যান্ডেজ

তবে এক্ষেত্রে রোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন হওয়ারও পরমর্শ দেন ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই যদি নিজেদের জায়গা থেকে একটু সচেতন হই, তাহলেও কিছুটা নিরাময় সম্ভব হতো।’

এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বার্ন ইউনিটের একজন সহযোগী অধ্যাপক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদেশে একজন বার্ন রোগীর জন্য একটি করে কক্ষ বরাদ্দ থাকে। কারণ বার্ন রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ইনফেকশন। এই রোগীরা একে অন্যের অন্যের ইনফেকশনের কারণ। কিন্তু আমাদের দেশে একজন বার্ন রোগীর জন্য একটি আলাদা কক্ষ রাখা সম্ভব নয়। এরপরও যতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটুকুও আমরা করতে পারছি না। এ জন্য দায়ী রোগীদের সচেতনতা অভাব। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এই দায় এড়াতে পারে না।’

/এমএনএইচ/