‘মুক্তামনির সুস্থতার জন্য আমরা সবাই যুদ্ধ করছি। অকারণে প্রবেশ করে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়াবেন না, আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’—ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের একটি কেবিনের দরজার বাইরে সাদা কাগজে এই কথা লিখে রাখা হয়েছে। বহুলকাঙ্ক্ষিত অস্ত্রোপচারের পর মেয়েটি কেমন আছে তা জানার কৌতূহল অনেকের। সবার ভিড়ে জটলা যেন না হয় সেজন্য ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই নোটিশ।
আইসিইউতে থাকার সময় সেখানকার সেবিকাদের যত্নআত্তিতে মুক্তামনি অত্যন্ত খুশি। এ তথ্য জানিয়ে তার বাবা ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘আইসিইউতে থাকা আপারা (নার্স) মুক্তামনিকে নিজের মেয়ের মতো দেখাশোনা করেছেন। তারা খুব ভালো ব্যবহার করেছেন আমার মেয়ের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে গল্প করেই সময় কাটতো ওর। এ কারণে কেবিনে আসার পর থেকেই আমার আম্মুজানের মন খারাপ। ও কাল আইসিইউ থেকে আসতেই চায়নি। কেবিনে আনার কথা জানার পর থেকেই সে কান্নাকাটি করেছে। সেখানকার নার্স আপারা আমাকে এটা বলেছেন।’
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অস্ত্রোপচার করা মুক্তামনির হাতের কাপড় বদলে দেওয়া হয়েছে। ‘আমার মেয়ের বিষয়ে এখানকার চিকিৎসকসহ সবাই যেভাবে লক্ষ্য রাখে তাতে আমরা সারাজীবনের জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম। এই স্যারদের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না’— বাংলা ট্রিবিউনকে কথাগুলো বলতে বলতে ভিজে আসা চোখ মোছেন ইব্রাহীম।
এদিকে কেবিনের দরজার নোটিশ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানালেন, মুক্তামনির এই সময়টা খুবই জটিল এবং তার যেন কোনও সংক্রমণ না হয় সেজন্যই দর্শনার্থী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি ভিড় না জমাতে এই অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গণমাধ্যমসহ সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, কেউ মুক্তামনির কেবিনে ভিড় করবেন না। মুক্তামনিকে ভালো করার জন্য আমাদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিন। মুক্তামনির বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। যদি কোনোভাবে কোনও সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে পড়ে সে, তাহলে আমাদের জন্য বিপর্য ডেকে আনবে।’
ঝুঁকি যদি থাকেই তাহলে মুক্তামনিকে আইসিইউ থেকে কেবিনে কেন আনা হলো জানতে চাইলে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আইসিইউতে অনেক রোগী আছেন। সেখানেও ক্রস ইনফেকশনের ঝুঁকি ছিল।’
এদিকে মুক্তামনির দ্বিতীয় বায়োপসি রিপোর্টেও তার রক্তনালীতে টিউমার ধরা পড়েছে বলে জানান ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক। আগামী ২০ আগস্ট পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিয়ে বৈঠক হতে পারে। ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমরা আগে যা বলেছিলাম, নতুন রিপোর্টেও সেটাই এসেছে। মুক্তামনির রক্তনালীতে টিউমার হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় হেমানজিওমা।’
গত ৮ আগস্ট মুক্তামনির প্রথম বায়োপসির রিপোর্ট হাতে পান চিকিৎসকরা। এই রোগটিকে বিরল বলা হলেও প্রথম বায়োপসি করার পর জানা যায়, তার রক্তনালীতে টিউমার (হেমানজিওমা) হয়েছে। ১২ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে মুক্তামনির অস্ত্রোপচার শুরু হয়। এই দায়িত্বে ছিল ৩০ জনের বেশি একটি চিকিৎসক দল। অস্ত্রোপচার করে তার হাত থেকে তিন কেজি মাংসপিণ্ড ফেলে দেওয়া হয়।
সাতক্ষীরার মুক্তামনিকে গত ১২ জুলাই ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তির পর প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা চারটি রোগের কথা ধারণা করেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেছে লিমফেটিক ম্যালফরমেশন রোগে আক্রান্ত সে। এটি একটি জন্মগত রোগ (কনজিনেটাল ডিজিস)। এর বিশেষত্ব হচ্ছে জন্মের পরপরই কিছু ক্ষেত্রে এর প্রকাশ পায় কারও ক্ষেত্রে, আবার কারও ক্ষেত্রে পায় না।
তবে মুক্তামনি এতদিন অবহেলা আর অপচিকিৎসার শিকার হয়েছে বলে পরিবার এবং চিকিৎসকদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে। অবশ্য তারা আশাবাদী, দীর্ঘমেয়াদী এক চিকিৎসার পরে তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
/জেএ/জেএইচ/