পারকিনসন্স ডিজিজের উন্নত চিকিৎসা চালু হচ্ছে বিএসএমএমইউ’তে

পারকিনসন্স ডিজিজ মস্তিষ্ক থেকে শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে (ছবি- ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

শিগগগিরই মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ পারকিনসন্সের উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এ। এজন্য খ্যাতিমান নিউরো সার্জন টিপু আজিজকে ইতোমধ্যে অনারারি প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। বিএসএমএমইউ’র কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা.  মোহাম্মদ আলী আসগর মোড়ল এ তথ্য জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউ’র নিউরো মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর ডা. আহসান হাবীব হেলাল জানান, উচ্চপর্যায়ের দক্ষতা সম্পন্ন সার্জনই শুধু এই অস্ত্রোপচার করতে পারেন। এটি করতে ভারতে ৩০-৪০ লাখ টাকা খরচ হয়, সিঙ্গাপুরে ৫০-৬০ লাখ টাকায় এই অস্ত্রোপচার হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে মাত্র দুজন রোগীর এই অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। বিএসএমএমইউ’তে আমরা এটি চালু করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। বাংলাদেশে এই অস্ত্রোপচারের কোনও নিউরো সার্জন নেই। মাত্র দুজন অবজারভেশন ট্রেনিং নিয়েছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ডের নিউরো সার্জন টিপু আজিজকে ইতোমধ্যে অফিসিয়ালি ‘অনারারি প্রফেসর হিসেবে’ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে যে ক’জন চিকিৎসক ডিবিএস (ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন) নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি তাদের মধ্যে একজন। আমরা তার মাধ্যমে আগামীতে ২-৩ জন রোগীর ডিবিএস করার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই।

তিনি আরও বলেন, ‘এই অসুখ নিয়ে আমরা প্রতি রবিবার বহির্বিভাগে মুভমেন্ট ডিজওর্ডার ক্লিনিক পরিচালনা করি। এখানে প্রতি রবিবার পারকিনসন্সের প্রায় ৫-১৫ জন রোগী আসেন।’

চিকিৎসকরা জানান, এই রোগে আক্রান্তের হার কতো তার সঠিক কোনও তথ্য নেই। তবে আন্তর্জাতিক হিসাব ও পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শতকরা দশমিক তিন ভাগ লোক পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়। এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। এটি প্রতিরোধের উপায় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে নিয়মিত ওষুধ সেবনে রোগী অনেক দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।

এ রোগের কারণ সম্পর্কে ডা. আহসান হাবীব হেলাল বলেন, ‘মস্তিষ্কের সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা নামক অংশের স্নায়ুকোষ (নিউরোন) শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ডোপামিন নামক নিউরো ট্রান্সমিটার (এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ)-এর ঘাটতি দেখা দেয়। স্বাভাবিক অবস্থায় মস্তিষ্কে ব্যাজালগ্যাংলিয়া নামক অংশ শরীরের চলাফেরা বা গতি বা নড়াচড়া করার সমন্বয় করে থাকে। ডোপামিনের অভাবে এই সমন্বয় নষ্ট হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘শতকরা ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগের কারণ জানা যায় না। পাঁচ শতাংশ জেনেটিক কারণে হয়। আর পঁচিশ ভাগ স্ট্রোক, টিউমার, বারবার আঘাত, মস্তিষ্কের ইনফেকশন, উইলসন ডিজিজসহ মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত অন্যান্য রোগের কারণে হয়। নারী ও পুরুষ উভয়েই সমানভাবে এই রোগে আক্রান্ত হন। ৫৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষদের এই রোগে আক্রান্তের হার বেশি। তবে জেনেটিক কারণে ১৫-২০ বছর বয়সেও এই রোগ হতে পারে।’

এ রোগের লক্ষণ সম্পর্কে এ চিকিৎসক বলেন, ‘হাত-পা কাঁপুনি, হাত-পা স্বাভাবিকের চেয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া, চলাচলের গতি ধীর হয়ে যাওয়া, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটা, কথার স্বর কমে যাওয়া, কম কথা বলা, চোখের পাতার নড়াচড়া কমে যাওয়া, বারবার পড়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ও হতাশাগ্রস্থতা—এসবই এ রোগের লক্ষণ। নিউরোলজির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রোগ স্ট্রোক, এই রোগে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পারকিনসন্সে আক্রান্ত হলে অক্ষমতা তৈরি হয়। রোগী শারীরিকভাবে কাজকর্ম করতে পারে না। চিকিৎসা না নিলে রোগী একসময় হাঁটতেও পারে না, পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে যায়। তবে এই ধরনের রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করলে সক্ষম থাকতে পারে। চিকিৎসা না নিলে একসময় হাঁটার শক্তি থাকে না। ঢোক গেলা ও খাওয়ার ক্ষমতাও থাকে না। খাবার খাওয়ার পর গেলার সময় তা শ্বাসনালীতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

সাধারণত এই রোগের কারণে রোগীর মৃত্যু হয় না। তবে এই অসুখের কারণে সৃষ্টি হওয়া অন্যান্য জটিলতায় রোগী মারা যায় বলেও জানান তিনি।

বিএসএমএমইউ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী আসগর মোড়ল বলেন, ‘আগে ধারণা ছিল খেলোয়াড়দের বেশি বয়সে এই রোগ হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এই রোগ সব বয়সে হতে পারে। যার কারণে আগের ধারণা পাল্টে গেছে। এর চিকিৎসার জন্য এন্টি পারকিন্সনিয়ান কিছু এক্সারসাইজ রোগীকে দেওয়া হয়। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মুষ্টিযুদ্ধের সময় বারবার মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে শেষ জীবনে এই রোগে আক্রান্ত হন।’

এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ডা. আহসান হাবীব হেলাল বলেন, ‘এমবিবিএস লেভেলের চিকিৎসকদের স্টুডেন্ট লাইফেই এ বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। তারা এ ধরনের রোগী দেখলে তা সহজেই অনুমান করতে পারেন। মেডিসিন স্পেশালিস্টরাও এ ধরনের রোগী দেখে থাকেন। তবে এই রোগের চিকিৎসা মূলত নিউরোলজিস্টরা করে থাকেন। এই রোগ সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে রোগীরা কখনও কখনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের রোগীদের নিয়মিত ওষুধ খাওয়া দরকার। ডায়াবেটিস রোগীদের যেমন সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়, এই রোগীদেরও তেমনি সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়। নিয়মিত ওষুধের ডোজ কখন বাড়াতে হবে, কখন কমাতে হবে তা নির্ধারণ করে দিই আমরা। যদি ওষুধের মাধ্যমে রোগীর উপসর্গ প্রশমিত না হয়, তবে ডিবিএস পদ্ধতিতে রোগীর মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রোড লাগানো হয়। এই ইলেক্ট্রোড মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশের স্নায়ুকোষকে উত্তেজিত করে পারকিনসন্স ডিজিজের উপসর্গ প্রশমিত করে। যখন ওষুধ কাজ করে না, তখন এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। তবে এই চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।’

বাংলাদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো এই রোগের ওষুধ উৎপাদন করছে এবং তা সুলভ মূল্যেই দেশে পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানান চিকিৎসকরা।