ক্যানসার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি কতটা যৌক্তিক?

ক্যান্সার চিকিৎসা
রাহেলা বেগম (৪৫) স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রথমে যশোরে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করান তিনি। সেখানে ভালো হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখতে না পেয়ে চলে আসেন ঢাকায়। বর্তমানে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। রাহেলার যে স্তনে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে, সেটি এখন আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ বড়। এটির ত্বক দেখতে অনেকটা গরুর চামড়ার মতো এবং স্তনটি শক্ত হয়ে গেছে।

শুধু রাহেলা বেগম নয়, তার মতো অনেক রোগী ক্যানসারের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আরও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে জানান অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসকেরা। এদিকে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের দাবি,  হোমিওপ্যাথি ওষুধেও ক্যানসার সারানো যায়। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৯ কোটি ৬ লাখ মানুষ শুধু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। ক্যানসার যে কারও হতে পারে। শিশু, তরুণ, বয়স্ক, ধনী-গরিব কেউই ক্যানসারের ঝুঁকিমুক্ত নয়। এটা রোগী, পরিবার এবং সমাজের জন্য বিরাট বিপদ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ এখন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। প্রাণঘাতী এই রোগে আক্রান্তদের ৩০-৫০ ভাগ যদি ধুমপান এড়িয়ে চলেন এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করেন, তবে ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। পুরুষেরা ফুসফুস, লিভার, কোলোরেক্টাল, স্টোমাক ও প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে, নারীরা ব্রেস্ট, ফুসফুস, স্টোমাক, কোলোরেক্টাল, সার্ভিক্যাল ক্যানসারে মারা যাচ্ছে। বিশ্বের প্রতি পাঁচটি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে মাত্র একটির ক্যানসার নীতিমালা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ডাটা আছে। 

ক্যানসার রিসার্চ ইউকে’র তথ্য মতে, হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে ক্যানসার রোগীরা চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। যদিও এর কোনও বৈজ্ঞানিক বা মেডিক্যাল এভিডেন্স নেই যে— এটি ক্যানসার সারাতে পারে বা ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে কাজ করে। এই ওষুধ খেলে ক্যানসার রোগীরা রিল্যাক্স বোধ করেন, স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং ডিপ্রেশন এবং সাইড ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে পারেন। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিটি হোমিওপ্যাথির বিষয়ে ফান্ড দেওয়া বন্ধ করার সুপারিশ করে। তারা বলে যে, হোমিওপ্যাথি যে ক্যানারের কোনও উপকার করে এমন কোনও প্রমাণ নেই। 

রাহেলা বেগমের অবস্থা কী করে এত খারাপ হলো, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘স্তন ক্যানসার ধরা পড়ার পর স্থানীয়দের পরামর্শে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিই। খুব বেশিদিন না, দুই-তিন মাস ওষুধ খাবার পরই আমার স্তনের এই অবস্থা হয়েছে।’

রাহেলার বাড়ি যশোরে। তিনি বলেন, ‘সেখানকার চিকিৎসকের পরামর্শে পরে আমি চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছি।’
‘রাহেলার মতো অনেকেই সচেতনতার অভাবে ক্যানসার ধরা পড়ার পর প্রথমে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেন। তারপর যখন দেখেন যে, রোগটি আরও  বাড়ছে এবং দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখন তারা অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে ছুটে আসেন’, বললেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোস্তফা আজিজ সুমন।

তিনি বলেন, ‘রাহেলার মতো অবস্থা নিয়ে যখন কোনও রোগী আমাদের কাছে আসেন, তখন আর বেশি কিছু করার থাকে না। তবে এরপরও আমরা চিকিৎসা চালিয়ে যাই।’ 

রাহেলা বেগম কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, ‘ ক্যানসার হওয়ার পর স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ছেলে মেয়েদেরও সে নিয়ে গেছে। আমারে পারলে আপনারা বাঁচান!’ 

চিকিৎসক ডা. মোস্তফা আজিজ সুমন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাহেলা বেগমের খুব একটা ভালো কিছু হবে না। তাকে আমরা কেমোথেরাপি দিচ্ছি। কিন্তু সেটা তার জন্য খুব ভালো কিছু হবে না।' 

তিনি বলেন, ‘‘হোমিওপ্যাথির ওপর আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের খুব বেশি বিশ্বাস। কিছু কিছু গণমাধ্যম (টিভি) হোমিওপ্যাথি নিয়ে লাগাতার প্রোগ্রাম করে থাকে। দি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে বলা হয়েছে ‘হোমিওপ্যাথি হ্যাজ নো রুল’। অর্থ্যাৎ কোনও রোগের ক্ষেত্রেই এর কোনও ভূমিকা নেই। আমি বলবো যে, আমাদের দেশের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকেরা যেকোনও রোগের ট্রিটমেন্ট করছে করুক, কিন্তু ক্যানসারের ট্রিটমেন্ট তারা যেন না করেন।’’
চাঁদপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রভাষক ডা. এস.জামান পলাশ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যানসার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির ভূমিকা খুব ভালো। এটা অ্যালোপ্যাথির চেয়ে মূলত ভালো। কিন্তু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি এগুলো দেওয়ার পরে রোগীদের অবস্থা আর ঠিক থাকে না। এগুলো থেকে রিকভারি করা খুব কঠিন হয়ে যায়।’

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় এপর্যন্ত কতজন ক্যানসার রোগী ভালো করতে পেরেছেন, জানতে চাইলে নির্দিষ্ট কোনও সংখ্যা উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘এপর্যন্ত অনেক ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা করেছি। আসলে আমাদের কাছে ব্রেস্ট আর ইউট্রাস ক্যানসারের রোগী বেশি আসে। আর  যারা (চিকিৎসক) নিজেদের বেশি প্রচার চান, কেবল তারাই কত রোগী সারিয়ে তুলেছেন, এমন তথ্য সংগ্রহ করে রাখের। আমার তো খুব বেশি অ্যাডভারটাইজমেন্টের দরকার নেই।’

বাংলাদেশে ক্যানসার প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা ভাইবোনেরা অসুস্থ হলে বাবা আমাদেরকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেন। বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখনও হোমিওপ্যাথির ওপর নির্ভরশীল। আমার নিজের আত্মীয় এস এ তালুকদার বাংলাদেশের একজন বড়মাপের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন। আমি আসলে কোনও চিকিৎসাকে হেয় করছি না। তবে এটুকু বলছি যে, আমরা মেডিক্যালে পড়াশোনা করতে এসে যেটা পেয়েছি, একেক ক্যানসারের একেক রকম বহিঃপ্রকাশ। আজকাল এত দামি ওষুধ বের হয়েছে, কিন্তু সব ওষুধ সবখানে কাজ করে— তা না। ব্যক্তিগত ইমিউনিটির ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। দেখা যাচ্ছে যে, একই ওষুধে কেউ উপকার পেলো কেউ পেলো না। এই যে অবস্থাটা, যেখানে আমাদের এত সায়েন্টিফিক্যালি ওষুধপত্র, অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, টেকনিক— এগুলোর পরও অনেক ক্ষেত্রে ঠিকভাবে ক্যানসার ভালো করতে পারে না। সেখানে শুধু লক্ষণনির্ভর চিকিৎসা দেওয়া হয়, আমি কোনও সায়েন্সকে অবজ্ঞা করতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘ যেহেতু আমি এটি ভালো করতে পারি না। কিন্তু আমি আমার সায়েন্স দেখে বলতে পারি যে, হোমিওপ্যাথিতে ক্যানসার রোগী খুব একটা উপকার পাবে— এটা আমার ধারণা হয় না। আমি হোমিওপ্যাথিকে অবহেলা করছি না, বা কাউন্টার বক্তব্য দিচ্ছি না। ক্যানসার যেভাবে হয় প্যাথোজেনেসিস বলি আমরা, যে গবেষণা এটা নিয়ে করা হয়, হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে যেটা জানি যে, লক্ষণনির্ভর যেভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়, এতে আমার ধারণা ক্যানসার রোগীর বেলায় খুব একটা উপকার হবে না। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে গিয়ে বেশিরভাগ রোগী আরও খারাপ অবস্থা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন।’ 

ডা. রাসকিন আরও বলেন, ‘আমরা সায়েন্টিফিক্যালি কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, সার্জারির কথাই বলবো। আমি মনে করি, আমরা ডায়াগনোসিস করে ক্যানসারের বিষয়টি বলি, এক্ষেত্রে আমরা বায়োপসি করি। ক্যানসারের যে বিধিসম্মত চিকিৎসা আছে, আমরা এগুলোর কথাই বলি। ক্যানসারের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে আমি সাজেস্ট করবো না।’