সড়ক জনাকীর্ণ, হাসপাতালে করোনা রোগীর ভিড়

গত ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত আগের আরোপ করা কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করেছে সরকার। ১৩ জুলাই আরোপিত বিধিনিষেধে ঈদ উদযাপন, ঈদে যাতায়াত, ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

তবে প্রজ্ঞাপনে এ সময় সর্বাবস্থায় জনসাধারণকে সতর্ক অবস্থায় থাকা এবং মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার কথাও বলা হয়েছে।

কিন্তু কঠোর সর্বাত্মক বিধিনিষেধ শিথিল করার পর থেকেই এতদিন ঘরে থাকা মানুষ একসঙ্গে বের হয়ে এসেছে। লকডাউন শিথিল হবার সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানী ঢাকা পুরনো সেই জ্যামের শহরে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন মার্কেট, শপিং মল ও দোকানপাট খুলেছে। চলছে গণপরিবহনও। সেখানে কোথাও কারও মুখে মাস্ক আছে তো কারও নেই। কারও পকেটে, কারও থুতনিতে অথবা কারও কানের পাশে ঝুলছে মাস্ক। নেই শারীরিক দূরত্বের বালাই।

আর এ শিথিল লকডাউন নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র ফটো সাংবাদিক নাসিরুল ইসলাম গতকাল শিথিল লকডাউনের প্রথমদিনে গাউছিয়া-নিউমার্কেট এলাকায় ছবি তুলতে যান। সেখান থেকে ফিরে তিনি জানান, মানুষের হাঁটার জায়গা নেই।

দুপুর সাড়ে ১২টায় বাইক নিয়ে তিনি বাটা সিগন্যাল হয়ে গাউছিয়ার দিকে যাচ্ছিলেন জানিয়ে বলেন, ইস্টার্ন মল্লিকা মার্কেট পার হয়ে সামনে যেতেই রিকশা, গাড়ি ও মানুষের জটলা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাইক ঘুরিয়ে আবার বাটা সিগন্যাল হয়ে এ্যলিফ্যন্ট রোড, ঢাকা কলেজের সামনের সড়কেও গাউছিয়া নিউমার্কেটের দিকে জ্যাম। তাই বাইক গ্লোব মার্কেটের নিচে পার্কিংয়ে রেখে হেঁটে গাউছিয়ায় পৌঁছালাম, বলেন নাসিরুল ইসলাম। 

এদিকে, লকডাউন শিথিলের সুযোগে ঢাকা ছাড়ছেন ঢাকার অনেক বাসিন্দা। প্রতিটি ফেরিঘাটে মানুষের ঢল নেমেছে। প্রতিটি লঞ্চে গাদাগাদি করে মানুষ যাচ্ছেন। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি উধাও। বর্তমানে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি নৌ-রুটে ৮০টি লঞ্চ ও ১৩টি ফেরি চলাচল করছে, কিন্তু যানবাহন ও মানুষের চাপে কুলিয়ে উঠতে পারছে না সেগুলো।

একই অবস্থা বাসস্টেশনগুলোতেও। গণমাধ্যমে এসেছে, যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে ১৪ কিলোমিটার এলাকায় থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

শিথিল লকডাউনে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশে পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে চলমান বিধিনিষেধ ১৫ থেকে ২২ জুলাই আট দিনের জন্য শিথিল করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর মনে করে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা সাপেক্ষে আমাদের সংক্রমণ বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

লকডাউন শিথিলের সুযোগে যেমন রাজধানীতে কয়েক লাখ মানুষের ভিড় বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে হাসপাতালের সাধারণ ও আইসিইউ ( নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) বেডের সংখ্যাও।

টানা পাঁচদিন ধরে করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ২০০ এর উপরে থাকলেও গত ২৪ ঘণ্টায় তা নেমে এসেছে ২০০ এর নিচে।তারপরও ১৮৭ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১২ হাজার ১৪৮ জন।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, রাজধানী ঢাকায় করোনা রোগীদের জন্য চিকিৎসা দেওয়া ১৬ হাসপাতালের মধ্যে ছয়টি বড় সরকারি হাসপাতালেই আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। তবে এ ১৬ হাসপাতালের মধ্যে তিনটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও সেখানে এসব রোগীদের জন্য আইসিইউ নেই। অর্থ্যাৎ ১৩ হাসপাতালের মধ্যে ছয়টি হাসপাতালেই আইসিইউ নেই।

আর এরমধ্যে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ২৭৫ বেডের মধ্যে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন ৬০ জন। আর বেসরকারি ডেডিকেটেড ২৮টি হাসপাতালের মধ্যে দুইটি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন। আর আটটি হাসপাতালে সাধারণ বেড খালি নেই। আইসিইউ খালি নেই ১০টি হাসপাতালে।  

ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোর তথ্য দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সাত বিভাগের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর মধ্যে ১৭টি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছে। তার মধ্যে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ১৯০ বেডের বিপরীতে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন ১০৪ জন। আর এক হাজার ২৮৭ আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র ২৮৭টি।

রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড একটি বেসরকারি হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তার হাসপাতালের ৯০টি সাধারণ শয্যা আর ১০টি  আইসিইউ বেড – এর সবগুলোই রোগীতে পূর্ণ।

“একদম সব ফুল হয়ে আছে, একদম সব”।

বেড খালি হবার আগেই ভরে যাচ্ছে অর্থ্যাৎ যদি পাঁচটা বেড খালি হয় তার জন্য হয়তো ২০ জন রোগী অপেক্ষায় থাকছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরেই এ অবস্থা চলছে।

মাঝে কিছু সময় এ হাসপাতালে নন-কোভিড রোগীদের জন্য বেড রাখা হলেও এখন সেই সুবিধা নেই। কিন্তু আবার সেটা পুরোটাই করোনা রোগীদের জন্য দিয়ে দিতে হয়েছে।

এই চিকিৎসক বলেন, তার নিজের আত্মীয়কে তিনি তার হাসপাতালের আইসিইউতে নিতে পারছেন না বেডের অভাবে। হয়তো আইসিইউ থেকে কেউ সুস্থ হলে অথবা মারা গেলে অন্য রোগীকে নেওয়ার সুযোগ হয়।

এদিকে, জায়গা নেই দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। সেখানে রোগীর চাপে বিশেষায়িত বিভাগেও রোগীদের রাখা হচ্ছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ও করোনা ইউনিটের দায়িত্বপালনকারী চিকিৎসক ডা. ফরহাদ হাছান চৌধুরী মারুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, করোনা ইউনিটের সব বেড ফিল-আপ।

“আর করোনা ইউনিটে গাইনি এবং সার্জারি বিভাগে কিছু বেড রয়েছে আলাদা- সেখানেও এখন মেডিসিনের রোগীদের রাখতে হচ্ছে”।

এগুলো খালি থাকতো সাধারণত, কিন্তু এখানেও এখন রোগীদের রাখতে হচ্ছে, বলেন ডা. ফরহাদ হাছান চৌধুরী।

আর আইসিইউর কথাতো বলাই বাহূল্য। একজন রোগী মারা যাচ্ছেন, তার জায়গায় আরেকজন রোগীকে রাখা হচ্ছে। আধাঘন্টা ধরে কোনও বেড ফাঁকা পরে রয়েছে- এমন রেকর্ড গত দুই সপ্তাহ ধরে নেই, বলেন তিনি।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, লকডাউন শিথিলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে। এখনই হাসপাতালগুলোতে কোনও বেড ফাঁকা নেই, বরং বিছানার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে।

“আমাদের আসলে সর্বনাশ হয়ে গেছে”, বলেন অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান।