দেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর হারও। গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রোগী বেড়েছে প্রায় তিনগুণেরও বেশি। এতে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর শয্যাতে রোগীর সংকুলান হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে। চিকিৎসকদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে রোগীর চাপ সামলাতে।
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। এই বছর এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৯৯ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৭৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় চিকিৎসাধীন। আবার কাছাকাছি পরিমাণ রোগী আছে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকাতেও।
ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্সরা জানান, রোগী প্রচুর আসছে, কাউকে তো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। আমরা চেষ্টা করছি চিকিৎসা দেওয়ার।
নরসিংদী থেকে আগত শাহরিয়ার জামিল গত ৩ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন, তার সঙ্গে পেট খারাপ। তাকে প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এরপর তার প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় এবং রক্তক্ষরণ দেখা দেওয়ায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয়।
রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক এবং নার্সরা। হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে মেঝেতেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায় ওয়ার্ডের বাইরেও অতিরিক্ত বেড বসিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু হলে রোগী বা সাধারণ মানুষ রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যাওয়াই নয়, বরং রোগী মারা যায় ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে। তাই প্লাটিলেটের সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে থাকলে ও রক্তপাত (অ্যাকটিভ ব্লিডিং) না থাকলে, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।
ঢাকার বাইরেও বেড়েছে ডেঙ্গু রোগী। সারাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৭১ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন। এছাড়া খুলনা বিভাগে ২৩০ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৩৮ জন, রংপুর বিভাগে ৭৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০৫ জন, বরিশাল বিভাগে ২৫৬ জন এবং সিলেট বিভাগে ১২ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর শীর্ষে আছে ঢাকা। ঢাকায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১২৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। এছাড়া বরিশালে ১৭ জন, চট্টগ্রামে ২২ জন, খুলনায় ১০ জন এবং ময়মনসিংহে ১ জন মারা গেছেন। রংপুর, রাজশাহী এবং সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কোনও ঘটনা পাওয়া যায়নি।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর বলছে, বছরব্যাপী ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলেও গত তিন বছর ধরে প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকছে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে। গত বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। ওই বছর প্রভাব বিস্তার করে ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরন। এবারও এই ধরনটির প্রভাবের ইঙ্গিত মিলেছে আইইডিসিআরের নমুনা বিশ্লেষণে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৯ দশমিক ২০ শতাংশ ডেন-২ আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এরপর ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ ডেন-৩ শতাংশ, ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ ৪ আক্রান্ত। তবে বিশ্লেষণে ডেন-১ আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, চিকিৎসাসেবা বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় সব রোগী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসছে চিকিৎসার জন্য। মাধ্যমিক হাসপাতাল বা প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসাব্যবস্থা থাকলে এর কয়েক গুণ বেশি রোগীর সেবা দেওয়া যেত। মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক কমানো যেতো।