স্বাস্থ্যসেবাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও রোগীকেন্দ্রিক করার পরামর্শ

দেশের প্রচলিত সামাজিক, ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার আলোকে স্বাস্থ্যসেবার নকশা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, অন্য দেশের মডেল অনুকরণ না করে, বাংলাদেশে মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও রোগীকেন্দ্রিক করতে হবে। এজন্য সেবা পরিকল্পনায় প্রসূতিবিদ, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা পেশাজীবী ও সেবাগ্রহীতাদের সম্পৃক্ত করা জরুরি।

মঙ্গলবার (৮ জুলাই) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশে মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি: স্থান, নকশা ও পদ্ধতিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানোন্নয়ন’ শীর্ষক নীতি সংলাপে এসব পরামর্শ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর হেলথকেয়ার ইমপ্রুভমেন্ট যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে।

সংলাপে অংশ নেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চিকিৎসক, স্থপতি-প্রকৌশলী, এনজিও প্রতিনিধি ও উন্নয়ন সহযোগীরা। বক্তারা বলেন, কমিউনিটি ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর নকশা ও সেবায় সামাজিক বাস্তবতা গুরুত্ব পেলে মাতৃ ও নবজাতক সেবার মান আরও বাড়বে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. শেখ সাইদুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আশরাফি আহমেদ। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী, গণপূর্ত অধিদফতরের প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বক্তারা বলেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর পুরনো নকশা, অতিরিক্ত ভিড় ও প্রসূতি-নবজাতকের জন্য আলাদা ইউনিটের অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। বাজেট সংকট, জনবল ও লজিস্টিক জটিলতায় হাসপাতাল সম্প্রসারণও ধীর।

তারা কমিউনিটি ক্লিনিকের সক্ষমতা বাড়ানো, ১০ শয্যার প্রসব কক্ষ, আল্ট্রাসাউন্ড, স্তন্যদান সহায়তা ও ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) চালুর সুপারিশ করেন। পাশাপাশি 'জিরো সেপারেশন' অর্থাৎ মা-শিশুকে আলাদা না রাখার বিষয়েও জোর দেন। এসব সেবা নিশ্চিত করতে রোগীর সুবিধা, গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিষয়, পরিচ্ছন্নতা ও মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়ে নকশা প্রণয়নের পরামর্শ দেন তারা।

বক্তারা বলেন, দেশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নকশা নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, এমনকি বুয়েটেও নেই। তাই স্থপতি-প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রোগীবান্ধব হাসপাতাল নির্মাণে গুরুত্ব দিতে হবে। সহজ কিছু উদ্যোগ যেমন প্রসব কক্ষে পর্দা, পানি সরবরাহ, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার মতো বিষয়েও নজর দিতে হবে, যা খুব বেশি অর্থও লাগে না।

তারা আরও বলেন, অনেক সিদ্ধান্ত এখনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যাস নির্ভর, নির্দেশিকা নেই। তাই প্রমাণভিত্তিক ও প্রেক্ষিত উপযোগী নির্দেশিকা তৈরি জরুরি।

এই সংলাপে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল, মাতৃস্বাস্থ্য ও অবকাঠামো কৌশলে ‘স্পেস’ বা স্থানের বিষয়টি যুক্ত করা এবং জাতীয় স্বাস্থ্য কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা; প্রসবকক্ষের গোপনীয়তা, প্রার্থনার স্থান ও উন্নত স্বাস্থ্যবিধি সুবিধাসহ স্পেস স্ট্যান্ডার্ড আপডেট করা; প্রতি পাঁচ বছরে একবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যালোচনা চালানো; গর্ভবতী নারীদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিবন্ধন এবং রেফারেল সিস্টেমের সঙ্গে একীভূতকরণ এবং রোগীবান্ধব সেবা প্রবাহ ও জনসমাগম ব্যবস্থাপনা চালু করা।

এছাড়া ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সমন্বিত সেবার পরিকল্পনা ও রেফারেল শক্তিশালী করা; গর্ভকালীন, প্রসব, প্রসবোত্তর ও নবজাতক সেবার জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক পুনর্গঠন; পানি, বিদ্যুৎ, বাতাস চলাচল ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান অবকাঠামোর মানোন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনায় রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা এবং উন্নয়ন বাজেটের উপর নির্ভরশীলতা কমানো।