চারদিকে নীলচে-সাদার মিশ্রণের স্বচ্ছ জল। এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় পাথর। যেন হাজার বছর ধরে পাহারা দিচ্ছে নীল জলের খালটাকে। একটু দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল পাহাড়। আকাশে মেঘদলের এলোমেলো ছুটোছুটি আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। স্বচ্ছ জলের বুকে ঠ্যাট-ঠ্যাট শব্দ তুলে ধীরগতিতে এগোচ্ছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। এসব মিলিয়েই আমাদের লালাখাল যাত্রা।
ব্যস বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম— এবার যাবো সিলেটের লালাখাল। একদিন রেলস্টেশন গিয়ে রাতের ট্রেনের টিকিট কাটার কাজ সেরে নিলাম। মনে রাখতে হবে, অন্তত দুই দিন আগে টিকিট কেনা ভালো। নইলে এই রুটে সাধারণত তাৎক্ষণিক আসন মেলে না।
ভ্রমণের উত্তেজনায় নির্ধারিত তারিখে বিকালের মধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম। রাত ১০টায় গিয়ে পৌঁছালাম বিমানবন্দর স্টেশন। কাঙ্ক্ষিত ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস এলো রাত ১০টা ২২ মিনিটে।
ট্রেন জার্নিটা উপভোগ্য ছিল বেশকিছু কারণে। প্রথমত মনে হচ্ছিল, আকাশে ঝলসানো রুটির মতো চাঁদমামাও ছুটে চলছে আমাদের সঙ্গে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। রূপালি আলোয় ট্রেনে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে লম্বা সাপের মতো উপবন এক্সপ্রেস এগিয়ে চললো। গল্প-আড্ডা আর হাসি-আনন্দে খন যে ভোররাত হয়ে এলো টেরই পাওয়া গেলো না! এরপর একটু ঘুমিয়ে নিলাম আমরা। কাল যে আবার ঘুরতে হবে খুব।
ঘুম ভাঙলো বন্ধুর ডাকে। সিলেটের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। ট্রেন সিলেট পৌঁছালো ভোর ৫টায়। ততক্ষণে সবাই নামার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি।
ঝকঝকে স্টেশন। হইচই নেই বললেই চলে। দু’চারজন গার্ড ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়লো না। হয়তো দিনের ব্যাস্ততা তখনও শুরু হয়নি এই স্টেশনে।
আর হ্যাঁ, ঘোরাঘুরির জন্য রেলস্টেশনের বাইরেই অনেক সিএনজি পাওয়া যায়। চাইলে সারাদিনের জন্যও রিজার্ভ নিতে পারেন। তবে দরদাম করে নেওয়া ভালো। আমরা অবশ্য সিএনজিতে যাইনি। ছুটলাম বাসের দিকে। বাসস্ট্যান্ড গিয়ে চেপে বসলাম জাফলংগামী বাসে। এবারের গন্তব্য সারিঘাট।
প্রায় ঘণ্টাখানেক যাত্রার পর বাস আমাদের সোয়ারিঘাট নামিয়ে দিলো। তখন সূর্য কেবল নিজের আকারে আসতে শুরু করেছে। সেখান থেকে রাস্তা পার হয়ে একটু খোঁজ নিয়ে অটোস্ট্যান্ড চলে গেলাম। অটোতে চেপে সোজা লালাখাল।
২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম লালাখাল। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম জলে। স্বচ্ছ টলমলে পানি। আমাদের মতো বালতিতে করে পানির জীবনে বেড়ে ওঠা যাদের, তাদের খুশি আর দেখে কে! জলে পা ডোবাতেই একনিমিষে উড়ে গেলো দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি।
নৌকা মূলত আমাদেরকে তিনটি স্পটে নিয়ে গিয়েছিল। সুপারি বাগান, জিরো পয়েন্ট ও একটি চা বাগানে।
শুরুতে নৌকা যত এগিয়ে চলছিল, মুগ্ধতা যেন তত বেড়ে চললো। চারপাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম সুপারি বাগানে। ইয়া লম্বা লম্বা সুপারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে পুরো বাগানে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে সতেজ হয়ে আছে সব। বাগান থেকে দাঁড়িয়েই ভারতের পাহাড়গুলো দেখা যায়।
অনেক ছবি তুললাম সেখানে। মনভরে উপভোগ করলাম প্রকৃতি। দাপাদাপি করলাম স্বচ্ছ শীতল জলে। সাঁতার জানা থাকলে তেমন কোনও বিধিনিষেধ নেই।
জিরো পয়েন্ট ঘোরার পর মাঝি আমাদের নিয়ে গেলো চা বাগানে। সেখানে সবুজের পর সবুজ। সিলেটের বিশেষত্ব আর সিলেট ট্যুরের প্রধান আকর্ষণ এটাই। চা বাগানের ভেতরের টিলা থেকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে চারদিক দেখতে। মন চায়— কর্মব্যস্ত জীবন ফেলে থেকে যাই হাজার বছর! কিন্তু ফিরতে হয়। ফেরার আগে স্নান সেরে নিলাম লালাখালে। তবে সাবধান, সাঁতার না জানলে গভীরে যাওয়ার দরকার নেই।
আমরা সিলেটে এসেই লাঞ্চ করেছিলাম। খাওয়া শেষ হতেই নেমে এলো সন্ধ্যা। রাতে সিলেট শহরে ঘোরাঘুরি করে দেখে নিলাম শহরটাকে। কিন ব্রিজ, শত বছরের পুরনো ঘড়ি, সুরমা নদী দেখে সিলেট রেলস্টেশন থেকে রাত ১০টার ট্রেনে ঢাকার পথে ছুটলাম সবাই। সারাদিনের ক্লান্তির কারণে ট্রেনে ওঠামাত্রই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো সবাই।
শহুরে ছকেবাঁধা জীবনে একটু লম্বা জার্নি বরাবরই আনন্দের। এতে মন সতেজ হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও নিজেকে চাঙা লাগে। শত ব্যস্ততার মাঝে একটু জার্নি স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয় আমাদের জীবনে। ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি প্ল্যাটফর্ম আছে। আমাদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে চাইলে যোগ দিতে পারেন ফেসবুক পেজ ছুটি দিগন্তে ট্রাভেল গ্রুপে।