এ গল্প পুরোপুরি মেঘ, পাহাড় আর জলের সঙ্গে মিতালীর। কাকডাকা ভোরে পুরো সিলেট ঘুমিয়ে থাকলেও কদমতলী বাসস্ট্যান্ড জেগে উঠলো আমাদের হাঁকডাকে। সেখান থেকে একদৌড়ে ক্বিন ব্রিজ পার হয়ে জিন্দাবাজার। সেখানে আছে একটি খাবার ঘর। নাম ‘পাঁচ ভাই’। মনে হয় জন্ম-জন্মান্তর ধরে সেখানে খেয়েই চলেছি! গরুর মাংস আর চালের আটার রুটির স্বাদ মুখে লেগে আছে।
সকালের নাস্তার পর চলে এলো ভাড়ায় নেওয়া লেগুনা। সারাদিন এই মোটরযান আমাদের জন্যই উৎসর্গকৃত। চলেছি হাদার পাড়ের দিকে। প্রকৃতির কোলে সেখানে আমরা হাঁদারাম সাজবো! পথে ১০১টা রূপের বাহারে চোখ ধাঁধিয়ে দিলো বর্ষার রূপসী সিলেট। শহর থেকে বের হলে চা বাগান, লাল মাটির পথ, টিলার সারি।
এবারের জার্নিতে সব যেন রেডিমেড পেয়ে যাচ্ছি। বন্ধু-সুহৃদ ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। বিনয় ভদ্রের ব্যবস্থায় এ পর্যন্ত এসেছি লেগুনায়। এবার তার তরিকা মেনে পেয়ে গেলাম নৌকাও। সঙ্গে আছে ফাহিম। সে এর আগে ছয়বার সেখানে গেছে। রীতিমতো বিছানাকান্দি-পানথুমাই বিশেষজ্ঞ। ঘাট থেকে নৌকা ছাড়লো। বাড়লো বৃষ্টির দমকাও। সেই শুরু। একটানা আমরা ভিজেছি পরবর্তী পাঁচ ঘণ্টা। বর্ষার শুরুতে এ কোন ঘোর লাগা বর্ষণের আবহ?
আকাশছোঁয়া পাহাড়ের পটভূমিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখায় একটি ছোট্ট গ্রাম। পাহাড় থেকে নেমে কুলুমছড়া এসেছে এখানে। সীমান্তরেখার ওপারে বলে ছড়ার কাছাকাছি যাওয়া উচিত হবে না জেনেও এর গর্জন আর স্রোতরাশি চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেলো ওপারে। ভারতবর্ষের সীমানায়। বজ্রের শক্তির কথা জানি, প্রথম দেখলাম জলরাশির শক্তি। পাহাড়ধোয়া লক্ষ কিউবেক মিটার পানি গড়িয়ে নামছে এ পাড়ে। কুলুমছড়ার এমনই রূপ। অবশ্য শর্ত একটাই— আসতে হবে ভরা বর্ষায়।
নির্ধারিত গাড়ি দর্শনার্থীদের যেমন একের পর এক বেষ্টনীতে নিয়ে যায়, তেমনি আমাদের নিয়েও নৌকা ছুটেছে মনভোলানো একেকটি স্পটে। বোনাস সীমান্তের ওপারের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় সারি। মেঘের আড়ালে কখনও কখনও ঢেকে যাচ্ছে বাঁকগুলো, কখনও আবার দৃশ্যপটে হাজির পাহাড় সারির বুক বেয়ে নেমে আসা দুধসাদা জলরাশির ঝরনাধারা।
এবার বাঁধনহারা ফটোসেশনের পালা। এমন সুযোগ কি প্রতিদিন আসে? জলধারাকে পেছনে রেখে একেকজন দাঁড়াচ্ছি আর ক্যামেরা চলছে ফটাফট। প্রকৃতিদেব ঠিক করেছেন এ গল্পের ব্যাপ্তি আরও বাড়াবেন। বিছানাকান্দি এখনও বাকি আছে। কুলুমছড়া, লক্ষ্মণছড়া, পানথুমাই হয়ে এলে বিছানাকান্দি পড়বে সবশেষে। দিনভর বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সবার কাহিল অবস্থা। একটু উষ্ণতা চাই। ঠিক হলো বিছানাকান্দির পাথুরে বিছানায় লম্ফঝম্ফ মেরে চাঙা হয়ে নেবো।
দূরের আকাশ ছুঁতে চাওয়া পাহাড়সারির পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বিছানাকান্দি শহুরে মানুষের কাছে হতে পারে ভূস্বর্গ বাংলাদেশের আরেকটি প্রতিচ্ছবি। সময়ের স্রোতে গা ভাসালে কিন্তু চলবে না। সেই ধর্ম মেনে ফিরে যাওয়ার পালা এবার। দিনব্যাপী এত প্রাপ্তির মাঝে একমাত্র অপূর্ণতা কাছের সীমান্ত হাট মিস করা।
সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে হাদার পাড় যাওয়ার সিএনজি পাওয়া যায়। জনপ্রতি ভাড়া ৮০ টাকা। সারাদিনের জন্য ভাড়া করলে খরচ পড়বে ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। তবে দল ভারী হলে সারাদিনের জন্য লেগুনা ভাড়া করাই বুদ্ধিমানের কাজ। খরচ পড়বে ২ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা। হাদার পাড় থেকে বিছানাকান্দি যাওয়ার নৌকা পাওয়া যায়। দিনভেদে ভাড়াও কমবেশি হয়। তবে উচিত হবে কুলুমছড়া, লক্ষ্মণছড়া, পানথুমাই ও বিছানাকান্দি যাওয়ার জন্য সারাদিনের চুক্তিতে নৌকা ভাড়া করা। খরচ ২ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকার মতো। বর্ষায় সেখানকার সৌন্দর্য ভুবনভোলানো। তবে যারা সাঁতার জানেন না তারা লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না।
ছবি: শামীমা মিতু