ট্রাভেলগ

বর্ষায় জাগে বিছানাকান্দি

ওপারেই ভারতঘুমঘোরে বৃষ্টিস্নানের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আকাশে মেঘের আকাল হতে পারে। তবে এতটুকু আশা ছিল— পথে নামলেই আকাশ থেকে মেঘের পথ বেয়ে নেমে আসবে শান্তির জলধারা। হলোও তাই। পথে নামার আগেই দিগন্ত কালো করে এসে গেলো শ্রাবণ মেঘের দল। দু’দিন টানা চলছে অবিশ্রাম জলপতন। খবর পেলাম সিলেটে বন্যা হওয়ার উপক্রম। অতঃপর হুটহাট পরিকল্পনা। জুয়েল থিওটোনিয়াসের এসএমএসের কল্যাণে সাড়া পড়ে গেছে আমাদের পরিচিত মহলে। এবারের দল বেশ ভারী হবে মনে হচ্ছিল। শেষতক দশজনে গিয়ে ঠেকলো।

এ গল্প পুরোপুরি মেঘ, পাহাড় আর জলের সঙ্গে মিতালীর। কাকডাকা ভোরে পুরো সিলেট ঘুমিয়ে থাকলেও কদমতলী বাসস্ট্যান্ড জেগে উঠলো আমাদের হাঁকডাকে। সেখান থেকে একদৌড়ে ক্বিন ব্রিজ পার হয়ে জিন্দাবাজার। সেখানে আছে একটি খাবার ঘর। নাম ‘পাঁচ ভাই’। মনে হয় জন্ম-জন্মান্তর ধরে সেখানে খেয়েই চলেছি! গরুর মাংস আর চালের আটার রুটির স্বাদ মুখে লেগে আছে।
সকালের নাস্তার পর চলে এলো ভাড়ায় নেওয়া লেগুনা। সারাদিন এই মোটরযান আমাদের জন্যই উৎসর্গকৃত। চলেছি হাদার পাড়ের দিকে। প্রকৃতির কোলে সেখানে আমরা হাঁদারাম সাজবো! পথে ১০১টা রূপের বাহারে চোখ ধাঁধিয়ে দিলো বর্ষার রূপসী সিলেট। শহর থেকে বের হলে চা বাগান, লাল মাটির পথ, টিলার সারি।

মেঘ-পাহাড়ের যুগলবন্দিমাঝে এবড়োথেবড়ো পথ কষ্ট দিলেও গোয়াইনঘাটের সীমানা পেরোতেই একে একে দৃশ্যপটে হাজির হলো সারি নদী, দিগন্তের পটভূমিতে ধোঁয়াটে পাহাড়ের সারি আর হাওরের ছোট ভাই ডুবন্ত বিল। এর মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরিণত হলো মুষলধারে। চারপাশে দিগন্ত অবধি পানির সমুদ্র। মাঝখান দিয়ে বাঁধানো পথ চলে গেছে সোজা গন্তব্যে। বর্ষায় গেলে হাদার পাড় অবধি এমনই সব দৃশ্যকল্পের কোলাজ।

এবারের জার্নিতে সব যেন রেডিমেড পেয়ে যাচ্ছি। বন্ধু-সুহৃদ ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। বিনয় ভদ্রের ব্যবস্থায় এ পর্যন্ত এসেছি লেগুনায়। এবার তার তরিকা মেনে পেয়ে গেলাম নৌকাও। সঙ্গে আছে ফাহিম। সে এর আগে ছয়বার সেখানে গেছে। রীতিমতো বিছানাকান্দি-পানথুমাই বিশেষজ্ঞ। ঘাট থেকে নৌকা ছাড়লো। বাড়লো বৃষ্টির দমকাও। সেই শুরু। একটানা আমরা ভিজেছি পরবর্তী পাঁচ ঘণ্টা। বর্ষার শুরুতে এ কোন ঘোর লাগা বর্ষণের আবহ?

অপরূপ পানথুমাই ঝরনাবিছানাকান্দি ও পানতুমাই সম্পর্কে জানতাম, কিন্তু কুলুমছড়ার নাম শুনিনি। মাঝির কাছে জানলাম সেদিকেই চলেছি। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দিগন্তের বর্ষাধোয়া পাহাড়ে চোখ রাখতেই দেখলাম, একটি সাদা রেখা নেমে গেছে পাহাড়ের শীর্ষ থেকে নিচের দিকে। নৌকা যত এগোচ্ছিল, সেই রেখাও যেন প্রশস্ত হচ্ছিল। দৃষ্টিসীমায় এলে বোঝা গেলো, এ নিছকই ঝরনা নয়, এটাকে জলজ্যান্ত জলপ্রপাত না বললে কম বলা হবে।

আকাশছোঁয়া পাহাড়ের পটভূমিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখায় একটি ছোট্ট গ্রাম। পাহাড় থেকে নেমে কুলুমছড়া এসেছে এখানে। সীমান্তরেখার ওপারে বলে ছড়ার কাছাকাছি যাওয়া উচিত হবে না জেনেও এর গর্জন আর স্রোতরাশি চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেলো ওপারে। ভারতবর্ষের সীমানায়। বজ্রের শক্তির কথা জানি, প্রথম দেখলাম জলরাশির শক্তি। পাহাড়ধোয়া লক্ষ কিউবেক মিটার পানি গড়িয়ে নামছে এ পাড়ে। কুলুমছড়ার এমনই রূপ। অবশ্য শর্ত একটাই— আসতে হবে ভরা বর্ষায়।

বিছানাকান্দির মনোরম সৌন্দর্যস্থানীয়রা বারবার তাড়া দিচ্ছিল, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী না টের পেয়ে যায়। অগত্যা কুলুমছড়ার মায়া কাটাতে হলো। বৃষ্টি থেমে গেছে। গোমরামুখো আকাশের নিচে ভাটির বাড়ন্ত জলরাশি কেটে নৌকা ছুটেছে লক্ষ্মণছড়ার দিকে। এই ছড়া বেয়েও ভারত থেকে জল এসে মিশছে বাংলাদেশের পানিতে। এখানকার মূল আকর্ষণ— ভারতীয় সীমানায় ছড়া এপার-ওপার করা একটি সেতু। কিন্তু জলস্রোত বেশি থাকায় নৌকা যেতে পারলো না সেই অবধি। দূর থেকে উঁকি মেরে মেটাতে হলো দর্শনতৃষ্ণা। এ যাত্রা অনেকটা যেন সাফারি পার্ক প্রদক্ষিণের মতো।

নির্ধারিত গাড়ি দর্শনার্থীদের যেমন একের পর এক বেষ্টনীতে নিয়ে যায়, তেমনি আমাদের নিয়েও নৌকা ছুটেছে মনভোলানো একেকটি স্পটে। বোনাস সীমান্তের ওপারের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় সারি। মেঘের আড়ালে কখনও কখনও ঢেকে যাচ্ছে বাঁকগুলো, কখনও আবার দৃশ্যপটে হাজির পাহাড় সারির বুক বেয়ে নেমে আসা দুধসাদা জলরাশির ঝরনাধারা।

মেঘ-পাহাড়ের যুগলবন্দিআকাশ এখন গাঢ় নীল নয়। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে দিগন্তের নীলিমা। এখানকার সবুজে অন্যরকম মাদকতা আছে। সঙ্গে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রিনিঝিনি এমন এক দৃশ্যকল্প হাজির করছিল, মনে হলো আমরা কি ভিনগ্রহে হাজির হয়েছি? চোখে বিস্ময়ের বিরতি পড়তে দিলো না পানথুমাই। কিছুক্ষণ আগে কুলুমছড়ার যে রূপ দেখে এসেছি, এর সৌন্দর্য তার চেয়েও মুগ্ধকর। নিয়মের বেড়াজালে খুব কাছে যাওয়ার উপায় নেই। দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল জলরাশির গর্জন। এর এমনই শক্তি যে, জলকণা পাথুরে শিলাখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মেঘ হওয়ার বাসনায় উঠে যাচ্ছে আকাশপানে।

এবার বাঁধনহারা ফটোসেশনের পালা। এমন সুযোগ কি প্রতিদিন আসে? জলধারাকে পেছনে রেখে একেকজন দাঁড়াচ্ছি আর ক্যামেরা চলছে ফটাফট। প্রকৃতিদেব ঠিক করেছেন এ গল্পের ব্যাপ্তি আরও বাড়াবেন। বিছানাকান্দি এখনও বাকি আছে। কুলুমছড়া, লক্ষ্মণছড়া, পানথুমাই হয়ে এলে বিছানাকান্দি পড়বে সবশেষে। দিনভর বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সবার কাহিল অবস্থা। একটু উষ্ণতা চাই। ঠিক হলো বিছানাকান্দির পাথুরে বিছানায় লম্ফঝম্ফ মেরে চাঙা হয়ে নেবো।

তোমায় দেখে আখিঁ না ফেরেপাথরের দুর্ভেদ্য সারি উপেক্ষা করে বয়ে যাচ্ছে পানির স্রোত। গা ভাসালাম সেখানে। দূরে খাসিয়া জৈয়িন্তা পাহাড়ের ফাঁক গলে বৃষ্টি হয়ে হানা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মেঘদল। স্রোতস্বিণী জলের আয়নায় তার ঘোরলাগা প্রতিবিম্ব। সমুদ্রসৈকতের চেয়ে কম কীসে বিছাকানাকান্দি!
দূরের আকাশ ছুঁতে চাওয়া পাহাড়সারির পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বিছানাকান্দি শহুরে মানুষের কাছে হতে পারে ভূস্বর্গ বাংলাদেশের আরেকটি প্রতিচ্ছবি। সময়ের স্রোতে গা ভাসালে কিন্তু চলবে না। সেই ধর্ম মেনে ফিরে যাওয়ার পালা এবার। দিনব্যাপী এত প্রাপ্তির মাঝে একমাত্র অপূর্ণতা কাছের সীমান্ত হাট মিস করা।

ওই দেখা যায় মেঘালয়মনোযোগ
সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে হাদার পাড় যাওয়ার সিএনজি পাওয়া যায়। জনপ্রতি ভাড়া ৮০ টাকা। সারাদিনের জন্য ভাড়া করলে খরচ পড়বে ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। তবে দল ভারী হলে সারাদিনের জন্য লেগুনা ভাড়া করাই বুদ্ধিমানের কাজ। খরচ পড়বে ২ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা। হাদার পাড় থেকে বিছানাকান্দি যাওয়ার নৌকা পাওয়া যায়। দিনভেদে ভাড়াও কমবেশি হয়। তবে উচিত হবে কুলুমছড়া, লক্ষ্মণছড়া, পানথুমাই ও বিছানাকান্দি যাওয়ার জন্য সারাদিনের চুক্তিতে নৌকা ভাড়া করা। খরচ ২ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকার মতো। বর্ষায় সেখানকার সৌন্দর্য ভুবনভোলানো। তবে যারা সাঁতার জানেন না তারা লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না।

ছবি: শামীমা মিতু