ট্রাভেলগ

সুপ্তধারার জাগ্রত রূপ

এমন রূপ দেখতে চাইলে যেতে হবে বর্ষায়বর্ষার মধ্যগগনে মন খারাপের বান ডেকেছে আকাশ। আমারও ভীষণ মন খারাপ। সেই সময়ের কথা বলছি, যখন সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে কিছুতেই ঢাকায় থাকতে চাইতাম না। কখনও সিলেট, কখনও চট্টগ্রামের জনবিরল উন্মুক্ত প্রান্তর, পাহাড়ি লালমাটির পথে কিংবা ঝরনা রাজ্যের শীতল আশ্রয়ে।

একবার কিছুতেই ব্যাটে-বলে করা যাচ্ছিল না। আমার সময় হয় তো অন্যরা ব্যস্ত। আবার সবাই তৈরি তো বৃষ্টির দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত মরিয়া পদক্ষেপ নিতে হলো। কেউ না গেলে মনকে বলবো, একলা চলো রে। বাসের টিকিট কাউন্টার থেকে শেষ মুহূর্তে ফোন দিলাম মিতুকে। আমতা আমতা করে সে নিমরাজি হলো। ওইদিকে আগের দিন থেকেই বৃষ্টির বিরাম নেই। আর বৃষ্টি মানেই ঝরনার অবিরত ছুটে চলা।

কীভাবে যেন আমাদের ‘ঘুরন্টি’ গ্রুপের সবার ছুটির দিন মানেই শনিবার। অথচ সারাদেশ ছুটির মেজাজে থাকে শুক্রবারে। এমনই এক শুক্রবারে সব দুর্ভাবনা মাটিচাপা দিয়ে চড়ে বসলাম বাসে। সঙ্গী মিতু আর রাকিব। গত কয়েকটা অভিযানে দেখা গেছে প্রচুর লোক। এবার আমরা মেরেকেটে মাত্র তিনজন। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। প্রকৃতির নন্দনকানন তার আঙিনায় বেড়াতে আসা আগন্তুকদের সবসময় আন্তরিক অভ্যর্থনা জানায়। কিন্তু শর্ত একটাই— নীরবে উপভোগ করতে হবে রূপসুধা। আমরাইবা তা মানবো কেন! দলবেঁধে না গেলে যেন ভালোই লাগে না। এবার ভাগ্যদেবী যেন ইচ্ছে করে দল ছেঁটে দিয়েছেন।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাস চলতে শুরু করলো। রাতের হাইওয়েতে বৃষ্টি দেখার মজা অন্যরকম। জানালার ঝাপসা কাচের ওপারে যখন অন্য গাড়ির হেডলাইটের আলো প্রতিফলিত হয়, সেই প্রতিবিম্ব পড়ে মনেও। ইচ্ছে জাগে পথের পাশের দিগন্তে অচিনপুরে পাড়ি জমাতে। মনের কোণে ভিড় করে ছেড়া ভাবনারা। হরেক রং তাদের। এমন সব ভাবনাগুচ্ছের মাঝে ঘুম নেমে এলো চোখে। পরদিনের আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা আর এতটুকুও নেই। ভারী বর্ষণে শীতল পৃথিবীর এক হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা বাসের আরামদায়ক আসনে নিজেকে ঘুমের তদারকিতে সঁপে দিলাম।

সুপ্তধারার জাগ্রত রূপভোরের দিকে ঘুমরাজার সুর সপ্তমে উঠতে না উঠতেই তাল কেটে দিলো কন্ডাক্টরের কর্কশ গলার স্বর। আমরা চলে এসেছি সীতাকুণ্ড বাজারে। বৃষ্টি তখনও ঝরছে সমানতালে। ঘুম জড়ানো চোখেই কোনোরকম ছাতা মাথায় বাস থেকে নামতেই আশ্রয়হীন আমরা। কোনও দোকানপাট তখনও খোলেনি। পৌনে ৫টার বৃষ্টিমোড়া ভোরে দোকান খুলতে বয়েই গিয়েছে মানুষজনের! আমরা একটি ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে। অবশ্য আমরা প্রস্তুত হয়েই এসেছি। রেইনকোট চাপিয়ে নিলাম আপাদমস্তক। রেইনকাভার থাকায় ব্যাগ আর ক্যামেরাগুলো নিয়ে ভাবনা নেই। আমাদের লক্ষ্য সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক।

সাধারণত পার্ক বললেই ব্যাকপ্যাকারদের যে নাক সিঁটকানো ভাব দেখা যায়, এই পার্কের ক্ষেত্রে কিন্তু তা খাটে না। বিশেষ করে বর্ষার সীতাকুণ্ড ইকোপার্কের ক্ষেত্রে। এখানে আছে সুপ্তধারা ও সহস্রধারা নামের দুটি ঝরনা। অন্য মৌসুমে যেমন তেমন হলেও বর্ষার সময় রীতিমতো জেগে ওঠে এ দুটি ঝরনাধারা। অনেক দিন সুপ্ত থাকার পর তারা যেন আগ্নেয়গিরির প্রজ্বলন্ত জ্বালামুখ! আমরা তার জ্বালায় শীতল হতে এসেছি!

প্রায় একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে সীতাকুণ্ড বাজার জাগতে শুরু করলো। দোকানে গিয়ে আগে গরম চায়ের সান্নিধ্যে শরীরটাকে উষ্ণ করে নিলাম। ঠিক করলাম নাশতা খেয়েই রওনা দেবো। সীতাকুণ্ড বাজারে খাবারের বেশ বৈচিত্র্য আছে। বিশেষ করে এখানকার গোবিন্দ হোটেলে নিরামিষ খাবারের স্বাদ অনন্য। আমরা তড়িঘড়ি নাশতা সেরে সিএনজি নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম।

সীতাকুণ্ড বাজার থেকে খুবই কাছে এই ইকোপার্ক। জনপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় পার্কের গেটে। সেখানে আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে উচুঁ-নিচু পিচঢালা বৃষ্টিধোয়া পথে চললাম জাগ্রত সুপ্তধারা দর্শনে।

নির্জন ছায়াঢাকা পথে গা ছমছম করতে লাগলো। এই ইকোপার্কের বনস্পতি বেশ সমৃদ্ধ। অর্জুন, চাপালিশ, জারুলসহ বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষে শোভিত চারপাশ। এখানকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় সন্দীপ চ্যানেলের বিপুল জলরাশি। দিগন্ত আর সাগরের অথৈ জলরাশিকে মিলিয়ে দিয়েছে বৃষ্টি। গেট থেকে হাঁটা শুরু করলে প্রথমে সুপ্তধারায় যাওয়ার নির্দেশনা আছে। পাহাড়ি পথে এখানে সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে একেবারে ঝিরিপথ পর্যন্ত। যেন আকাশ থেকে একেবারে পাতাল। আমরা সেই পথেই নেমে গেলাম ঝিরিতে। নেমেই বুঝলাম প্রকৃতি দেব আমাদের প্রতি প্রসন্ন। পানিতে টইটম্বুর ঝিরি। তার মানে সুপ্তধারায় বৃষ্টিধোয়া জলের বান ডেকেছে। বেশ কয়েকবার ঝিরি এপার-ওপার করতে হলো। জঙ্গলের পথে কিছুটা হাঁটতেও হলো।

এ জলধারা মানে না কোনও বাধাশেষের দিকে ঝিরি মোটামুটি মসৃণ। শেষ বাঁকটি ঘুরতেই প্রথম দর্শনে মাথা একেবারে ঘুরিয়ে দিলো সুপ্তধারার গর্জন। পাথুরে আড়াআড়ি মঞ্চের পুরোটা জুড়ে ঢল নেমেছে। পর্বত অরণ্য দেব যেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করছেন এই জলবণ্টন। এমন তীব্র তার বেগ আর গর্জন যে নিজেদের কথাও শুনতে পারছি না। বৃষ্টিজনিত ঢলের কারণে পানি ঘোলা। সব তো আর একসঙ্গে পাওয়ার উপায় নেই। আপাতত সুপ্তধারার জাগ্রত রূপই মুগ্ধ হয়ে দেখি। এর চেয়ে বেশি বিশেষণ দিতে পারছি না আর। কিছু কিছু সময় আসে যখন প্রকৃতিকে আর কোনও বিশেষণে সিক্ত করার কিছু থাকে না। প্রকৃতি হয়ে যায় চালিকাশক্তি আর আমরা মানুষেরা সামান্য ক্রীড়নক। আমরা তাই আর বেশি সক্রিয়তা দেখাতে গেলাম না। শুধু ক্যামেরার কয়েকটা ক্লিক। এর বেশি কিছু করতে গেলে প্রকৃতি দেব রুষ্ট হবেন।

বৃষ্টি তখনও ক্লান্তিহীন। বাতাসের বেগ বাড়ছে। কিছুক্ষণ পর সুপ্তধারার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল হয়ে গেলো। ভয়াবহ সুন্দর কোনও কিছুর স্বাদ অল্প করে নিতে হয়। তাহলে মানসপটে অনেক দিন পর্যন্ত তা জাগ্রত থাকে। আমরা ধরলাম ফিরতি পথ। আবার সেই পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। এবার সহস্রধারার পথে। এই নামে অবশ্য আরেকটি ঝরনা আছে। কাছাকাছি অঞ্চলেই। এটি মূলত সহস্রধারা-২ নামে পরিচিত। তবে সুপ্তধারার মতো অত বেঢপ নয়। ছিপছিপে ফিতের মতো তার চলন-বলন। কিন্তু ভরা বর্ষার স্পর্শ পেয়ে সেও তোড়জোর শুরু করেছে। এর সামনে শুয়ে-বসে থাকার বিশাল বালুকাময় উঠান। কেউ চাইলে শুয়েও এর রূপে মুগ্ধভক্ত বনে যেতে পারেন। আমাদের ওপর আলস্য ভর করলো পুরোমাত্রায়। পরিকল্পনা ছিল আরও এক জায়গায় যাওয়ার। কিন্তু প্রকৃতি সদয় হয়ে আমাদের ঝুলিতে যে দুর্দান্ত স্মৃতিস্মারক উপহার দিলো তাতে আপাতত এখানকার আর কোথাও না গেলেও কোনও ক্ষতি নেই। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে তাই ধরলাম বাড়ির পথ।

কম যায় না সহস্রধারাওমনে রাখবেন
সিএনজিসহ পার্কে প্রবেশের টিকিট মূল্য ৮০ টাকা। শুধু টিকিটের দাম ২০ টাকা। ঢাকা থেকে এলে সীতাকুণ্ড বাজারে নামাই ভালো। চাইলে মহাসড়কের ধারে পার্কের ফটকের সামনেও নামতে পারেন। সীতাকুণ্ড বাজারে গোবিন্দ হোটেলের নিরামিষ খাবারের স্বাদ অবশ্যই নেবেন।

সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে নিরাপত্তাজনিত কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। তাই কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ট্রেইল ছেড়ে নতুন পথে না যাওয়াই নিরাপদ। পার্কের একটি পথ চলে গেছে চন্দ্রনাথ চূড়ার দিকে। ওই পথে যাওয়া নিষেধ। সুপ্ত আর সহস্রধারার ওপরেও অনেকে যান। সেখানে কতগুলো সুন্দর ক্যাসকেড আছে। কিন্তু সাবধান, পথ কিন্তু ভীষণ পিচ্ছিল।

ছবি: কামরুল হাসান রায়হান