কাকভোরে গিয়ে নামলাম সুনামগঞ্জে। তারপর লেগুনায় চড়ে তাহিরপুর। সকালের নাশতা সেরে আগে থেকেই রিজার্ভ করে রাখা ট্রলারে গিয়ে বসলাম। ৫০ জনের বিশাল টিম হাওরে দুই দিন থাকবে। তাই আমাদের অ্যাডমিন মামুন ভাই বাজার সওদা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে কখন হাওরের উদ্দেশে যাত্রা করবো সেই অপেক্ষায় ট্রলারে বসে আছি আমরা।
তাহিরপুর বাজারের পাশ দিয়ে শান্ত নদীর জল বয়ে যাচ্ছে। নদীর বুকে চলছে অনেক ট্রলার। সেগুলোর ঢেউয়ের তোড়ে আমাদের ট্রলারও দুলছে। পূবদিকের সূর্যটা ক্রমে মাথার ওপর উঠে আসছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরম। অপেক্ষা করতে করতে পানিতে লাফ দেবো কিনা ভাবছি। তখনই মামুন ভাইয়ের আগমন।
পরিষ্কার পানিতে ওপর থেকে পানির নিচের সবুজ অংশ দেখতে চমৎকার লাগছিল। ইঞ্জিনের মৃদু গম্ভীর গর্জন তুলে পানির বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রলার। সামনে অথই জল। কখনও চোখে পড়ে পানির ওপর দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলো। কখনওবা দেখা যায় হাওরের মাঝেই একগুচ্ছ পল্লব সারি।
ট্রলার এগিয়ে চলছে গন্তব্যের পানে। আমরা গিয়ে পড়লাম আরও সুগভীর জলে। সেখানকার পানি আরও নীল। সম্ভবত পাহাড় ঘেঁষা নদী বলেই নীলে নীলে নীলাঞ্জনার মতো সেজে আছে।
দুপুরের তপ্ত রোদ মাথায় নিয়েই আমরা চললাম টেকেরঘাটে। ট্রলার থেকে নেমে প্রথমে বাইকযোগে ভারত থেকে আসা লাকমাছড়া দেখতে গেলাম। ছড়াতে প্রচণ্ড স্রোত। নিচের পাথরে পানির প্রবাহ বাধা পেয়ে স্রোত এগিয়ে চলছিল এঁকেবেঁকে। পাথরে পা রেখে ঠাণ্ডা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে মন্দ লাগছিল না।
পথিমধ্যে গাছের ছায়ায় বসে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলাম। হাওরের তরতাজা বোয়াল মাছ রান্না করা হলো। সবাই অনেক তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি। খাবারের পর্ব শেষে ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশে ট্রলার ছাড়লো।
সারাদিন প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়ানো সূর্যটা তখন পশ্চিম আকাশে ডুবতে শুরু করেছে। পশ্চিমে সূর্যের গোধূলি লগ্ন, উত্তরে মেঘালয়ের পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়ানো মেঘ, নিচে স্বচ্ছ নীল জলরাশি দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি কোনও স্বপ্নপুরিতে আছি! আমরা ক্রমে টাওয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর সূর্যটাও পাল্লা দিয়ে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিচ্ছে। অবশেষে টাওয়ারের গোড়ায় নৌকা বাধার সময় সূর্য ডুবে গেছে। সবাইকে লাইফ জ্যাকেট দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে নেমে গেলাম পানিতে। বেশ কিছুক্ষণ দাপাদাপি আর জলকেলিতে মেতে রইলাম আমরা। গোসল শেষে ট্রলার নোঙর করা হলো হাওরের পাশেই একটা ছোট বাজারে।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৮টার ঘরে। ফুরফুরে দক্ষিণা হাওয়া বইছে। চাঁদটা ঢেকে আছে মেঘের আড়ালে। চাঁদ যেন নিজেকে মেঘের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে চাইছে। কিন্তু খানিক পরেই দুষ্ট মেঘ এসে আবারও তাকে আড়াল করে দিচ্ছে।
ওদিকে চাঁদ মেঘের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছে ততক্ষণে। মাথার ওপরে ছড়াতে লাগলো জ্যোৎস্নার দ্যুতি। চাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যেন পানিও নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করলো। ফুরফুরে দক্ষিণা হাওয়ায় পানিতে ঢেউ উঠলো। ঢেউয়ের ওপর চাঁদের আলোর প্রতিফলনে মনে হলো মুক্তোদানা ভেসে বেড়াচ্ছে। চাঁদের আলো, ঢেউ, দক্ষিণা হাওয়া, গানের আসর; সব মিলিয়ে অসাধারণ ভালোলাগার অনুভূতি ছড়ালো সবার মনে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে শেষ হলো গানের আসর। এরপর নৈশভোজ জমলো মুরগির মাংসে। খেয়েদেয়ে ট্রলারের ছাদেই ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন প্রত্যুষেই ঘুম থেকে উঠে গেলাম। সূর্যটা তখন উঠি উঠি করছে। আমাদের কয়েকজন তখন ডিঙি নৌকায় চড়ে হাওরের পানিতে বেড়াচ্ছে। এরই মধ্যে আকাশ থেকে নেমে এলো বৃষ্টি। বাধ্য হয়েই ট্রলারের ভেতরে আটকে থাকতে হলো। বৃষ্টির ফাঁকেই চলছে ডিম-খিচুড়ির আয়োজন।
বৃষ্টি থামার পর সূর্যটা উত্তাপ নিয়ে মাথার ওপর গমগম করতে লাগলো। ওদিকে খিচুড়ি রান্না শেষ। এবার সবাই মিলে ভক্ষণের পালা। জমায়েত হয়ে খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতার পর্ব সেরে নিলাম। আবারও গর্জে উঠলো ট্রলারের ইঞ্জিন। এবারের গন্তব্য শিমুল-বাগান।
এরপর হাওরের পরিবর্তে নদীর দু’ধারে শুরু হলো ফসলি মাঠ। নদীর পাড়ে গোসল করছে ছেলেমেয়েরা। এ যেন খাঁটি বাংলার প্রকৃতি। নদীর বাঁক ঘুরতে ঘুরতে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম শিমুল বাগানে। অন্তত ১০ একর জায়গা তো হবেই। বাগান বটে! সবখানে সারি সারি শিমুল গাছ। বাগানে এখন ফুল নেই। তাতেও সৌন্দর্য একটুও ম্লান হয়নি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বাগান জুড়ে শিমুল ফুল ফুটে থাকে, তখন দেখতে না জানি কত সুন্দর লাগে!
বাগান দেখা শেষে আমরা গেলাম বারিক্কা টিলায়। ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে এর অবস্থান। লাফিয়ে লাফিয়ে টিলার ওপরে উঠলাম। ওপর থেকে জাদুকাটা নদী দেখতে মোটামুটি দর্শনীয়। ভারতের দিকের পাহাড় আরও উঁচু।
টিলার ওপর থেকে নেমে নদীর ওপারে গিয়ে চললো পানিতে দাপাদাপি। যে যার মতো লাইফ জ্যাকেট নিয়ে জাদুকাটা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নদীর একপাশ বালুকাময় তীর। আমি এক ভাইয়ের কাঁধে উঠে লাফালাফি শুরু করলাম। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চললো গোসল পর্ব।
আমাদের সব স্পট দেখা শেষ। সবাই রোদের উত্তাপ এড়াতে শামিয়ানার নিচে গিয়ে বসলাম। ট্রলার ফিরতি পথ ধরলো। প্রায় আধঘণ্টা চলার পর গাছের ছায়ায় বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছি। মেন্যুতে ছিল নাম না জানা জলজ পাখির মাংস। খেতে অনেক নরম আর সুস্বাদু।
আমাদের গন্তব্য ক্রমে কাছে চলে আসছে। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। আমরাও তাহিরপুর ট্রলার ঘাটে গিয়ে পৌঁছালাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়বে বলে! ট্রলার থেকে নামতেই বুকটা কেমন ভারি হয়ে উঠলো। হাওরকে বিদায় জানাতে হবে যে!