লারকে পাস। উচ্চতা ৫ হাজার ১০৬ মিটার। বেসক্যাম্প থেকে ২০-২৫ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছানো যায় সেখানে। যারা মানাসলু সার্কিটে ট্রেকিং করতে আসবেন তাদের জন্য প্রধান বাধার নাম ‘লারকে পাস’। এই পরিক্রমার সবচেয়ে উঁচু জায়গা গিরিপথটি। অসংখ্য প্রেয়ার ফ্ল্যাগে বর্ণিল এই স্থান। সবাই নামফলকের কাছে এসে ছবি তুলছে। মুহিত ভাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এটাই এখন পর্যন্ত আমার সর্বোচ্চ উচ্চতা ডিঙোনো।
কান পাতলে শোনা যায় সুযোগসন্ধানী ল্যামারগিয়ারের চিৎকার। সম্ভবত খাদ্যসন্ধানী কোনও মর্মটের (এক ধরনের ইঁদুর) দেখা পেয়েছে। ল্যামারগিয়ার হলো হিমালয়ের প্রবাদপ্রতিম প্রজাতির শকুন। মাঝরাতের বৈশাখী বাতাসের সঙ্গে বেসক্যাম্পের হিম হাওয়াকে মিলিয়ে ফেলি এখনও। চির আরাধ্য গোপনপুর ছেড়ে এসে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘিঞ্জি কোলাহলময় শহরের একটিতে বসে এখন আমার স্মৃতিচারণের পালা।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। হিমালয় তখনও স্বপ্ন কল্পনায়। সারা দিনমান সেখানে ছুটে যাওয়ার আকুলি-বিকুলি মনের ভেতর। একদিন সুযোগ এসেও গেলো। মন থেকে কিছু চাইলে বেশিরভাগ সময়েই তা পাওয়া যায়। আমাকে জানানো হলো, বাংলাদেশ থেকে একটি পর্বতাভিযানে সুযোগ পাচ্ছি। অভিযানের রোমাঞ্চের চেয়ে তখন হিমালয়ের রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদনের আনন্দ বেশি খেলে গেলো মনে।
দেখতে দেখতে এসে গেলো যাওয়ার দিন। আকাশ বেশ অশান্ত। সিটবেল্ট বেঁধে বসতে বলেছেন পাইলট। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের দমক এসে ধাক্কা দিচ্ছে আমাদের আকাশপাখিটাকে। এ কারণে মৃদু কাঁপছে বিমানের অভ্যন্তর। প্রথম অভিজ্ঞতা বলেই কিনা ভয়ে কাঁপছি। হঠাৎ মেঘের দঙ্গল ফুঁড়ে আমরা উপস্থিত হলাম একচিলতে নীল উঠোনে। পুরোপুরি পরিষ্কার আকাশ। আরও অবাক করে দিয়ে ছোট্ট জানালা গলে একটু নিচেই রঙধনু দেখা যাচ্ছে। এয়ার ট্রাফিকের কারণে কাঠমান্ডুতে নামতেও খানিকটা দেরি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে এসে দেখি ঘড়ির কাঁটা বিকাল ৫টার ঘরে।
পরের দিন কাটলো চরম ব্যস্ততায়। অভিযানের সব কেনাকাটা সারা হবে একদিনে। কোনও কিছু মিস হলে আর রক্ষে নেই! পর্বতাভিযানে ছোট্ট একটি জিনিসের অভাবও অনেক ভোগাতে পারে। তাই সুঁই-সুতো পর্যন্ত সব খুঁটিনাটি জিনিসপত্র তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে কেনা হলো। এর মধ্যে আমাদের এজেন্সি ক্লাইম্বালায়ার অফিসে গিয়ে অভিযানের শেরপা গাইডদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।
আরুঘাটের চেহারা আমাদের যেকোনও মফস্বলের মতোই। বিকালে আমরা ঘুরতে বের হলাম। সামনে তাদের নিজস্ব কোনও উৎসব আছে বোধহয়। রঙে র পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানি। বুড়িগন্ধাকী নদীর ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে ওপারেও গেলাম। গিরি শ্রেণির গভীর থেকে বরফগলা জল বয়ে নিয়ে চলেছে এই নদী। আগামী কয়েকদিনে আমরা বুড়িগন্ধাকীর উজান ধরেই চলবো। স্থানীয়দের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে আমাদের আশ্চর্য মিল। রাতে ডাল, ভাত ও চিকেন। সেই সঙ্গে পাপড়ভাজা ও মজাদার আচার দিয়ে জম্পেশ খাওয়া হলো। অবশ্য এ ধরনের খাওয়া নেপাল জুড়েই প্রচলিত। একটি প্রবাদ এ দেশে খুবই জনপ্রিয়— ‘ডাল ভাত পাওয়ার, টোয়েন্টি ফোর আওয়ার, অল ডে ওয়াক, নো শাওয়ার।’ হিমালয়ে ট্রেকিংয়ের বেলায় তাদের বাক্য মেনে চলতেই হবে।
বুড়িগন্ধাকীর তীর ধরে প্রথম দিন আমরা পৌঁছাই লাপুবেসি। চারদিকে অবারিত সবুজের রাজত্ব। চারপাশে দারুণ সব ঝরনা। একেকটার আকার দেখলে ভিড়মি খেতে হবে। নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। রাতের নির্জনতা তো ছাড়, দিনের কোলাহলও চাপা পড়ে যায় এর গর্জনে।
দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য ছিল খোরলা বেসি। সেখানে হলো দারুণ এক অভিজ্ঞতা। একেবারে বলা যায়— গ্লেসিয়ার গলে যাওয়া হিমশীতল জলে স্নান করতে নেমেছিলাম। প্রথম ডুবে শরীর যেন অবশ হয়ে এলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই টের পেলাম আর ক্লান্তি কিংবা ব্যথা নেই। পুরো টনিকের মতো কাজে দিয়েছে এই আইসবাথ থেরাপি। তৃতীয় দিন জগত হয়ে পরের দিন পেওয়াতে ছিলাম আমরা। চতুর্থ দিন দুই হাজার মিটার উচ্চতার নামরুং। পরদিন আমরা যাত্রা করি সামাগাওয়ের পথে।
পৃথিবীতে আট হাজার মিটারের পর্বত ১৪টি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটিকে কেন্দ্র করে পরিক্রমা পথ আছে। যেমন অন্নপূর্ণা সার্কিট কিংবা ধওলাগিরি সার্কিট। মানাসলুকেও কেন্দ্র করে চারপাশ ঘিরে ট্রেক করা যায়। আমাদের অভিযানেরও একটি লক্ষ্য কিন্তু মানাসলু সার্কিট ট্রেক করা।
সামাগাওতে পরদিন আমাদের বিশ্রাম। এদিন আমরা হাইট গেইনের জন্য মানাসলু বেসক্যাম্পের দিকে গেলাম। চার হাজার মিটার উচ্চতায় যাওয়ার পর সেখানেই থামলাম। এই জায়গা থেকে চারপাশের পৃথিবী অন্যরকম। মাথার ঠিক ওপরে মানাসলু শিখর। নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছে, পান্না সবুজ জলের বীরেন্দ্র তাল। লেককে ‘তাল’ বলা হয় হিন্দিতে। দূরে বিন্দুর মতো সামাগাও দেখা যাচ্ছে। আমরা যেখানে বসে আছি তার চারপাশেই হরেক রকমের নাম না জানা ফুল। নানান বৈচিত্র্যের অমূল্য ভাণ্ডার হিমালয়ের এই গোপনপুর। এই উচ্চতা থেকে আমরা ‘গো হাই, লো স্লিপ’ নীতি অনুসরণ করবো। অর্থাৎ যতদূর পর্যন্ত যাবো তার চেয়ে নিচে ঘুমানোর পরিকল্পনা। এতে উচ্চতাজনিত অসুখ হওয়ার ঝুঁকি কমে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো কিছুটা টেনশন নিয়ে। আমাদের আজকের গন্তব্য ৪ হাজার ৪৬০ মিটার উচ্চতার ধর্মশালা। এর আগে এত উচ্চতায় রাত কাটানো হয়নি। যদি কোনও অসুস্থতায় আক্রান্ত হই! সেইসব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে তৈরি হয়ে নিলাম। নাশতা সেরে ধর্মশালার পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম আমরা। অবশেষে ১২টা-সাড়ে ১২টা নাগাদ সুস্থভাবেই পৌঁছা গেলো ধর্মশালায়। লারকে বেসক্যাম্প ও পাসের আগে এটাই শেষ আশ্রয় আমাদের। এখানে কোনও স্থায়ী বসতি নেই। কিছু পাথুরে ঘর আর বেশিরভাগই অস্থায়ী তাঁবু। প্রথমবারের মতো তাঁবুতে থাকার অভিজ্ঞতা হবে আমার। প্রথমবারের মতো ল্যামারগিয়ারের সঙ্গেও দেখা হলো। বিশাল ডানা মেলে খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে সে।
ধর্মশালা থেকে পরদিন আমরা যাত্রা করলাম বেসক্যাম্পের পথে। টানা নয় দিন ট্রেকিংয়ের পর ২২ অক্টোবর অবশেষে আমরা পৌঁছালাম ৫ হাজার ৮৬ মিটার উঁচু বেসক্যাম্পে। ট্রেকিংয়ের শুরু থেকে এ পর্যন্ত চমৎকার আবহাওয়া পেয়েছি। ২৩ অক্টোবর ৫ হাজার ৬৫০ মিটার উঁচুতে হাইক্যাম্প স্থাপন করা হলো। সেদিন থেকেই আবহাওয়া বিরূপ হতে থাকে। প্রচণ্ড তুষারপাত ও বাতাস বইতে থাকে। এর মধ্যেই সঙ্গীরা ওপরে চলে গেলেও আমি বেসক্যাম্পেই রইলাম। একজন পোর্টার আছেন অন্য তাঁবুতে। বেলা কিছুটা বাড়তেই আবহাওয়া আরও প্রতিকূল হয়ে গেলো। নির্জন এই প্রান্তরে ভয়ঙ্কর বেগে বইতে থাকা হাওয়া আর তার সঙ্গে ছিটকে আসা বরফ টুকরোগুলোই আমার সঙ্গী। আপাতদৃষ্টিতে বেশ ভীতিকর পরিবেশ। একা তাঁবুতে বসে আছি, এর মধ্যেও রোমান্টিকতা ভর করলো। কিন্তু গান শোনার ব্যবস্থা নেই। একটা ম্যাগাজিন আছে সঙ্গে। সেটাই পড়া শুরু করলাম। চারপাশে মনোযোগ বিঘ্ন করার মতো অনেক কিছুই ঘটতে পারে। কিন্তু একবার নিজের মাঝে ডুব দিতে পারলে দারুণ কিছু সময় কাটানো যায়। দুর্যোগময় আবহাওয়ায়ও খুব একটা অসুবিধা হলো না। এভাবেই কেটে গেলো রাত।
পরদিন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে বেরিয়েছি। দূরে হাইক্যাম্পের পথে কিছু কালো বিন্দুকে নেমে আসতে দেখলাম। চিনতে ভুল হলো না। পানি আর চকোলেট নিয়ে ছুটে গেলাম। অভিযাত্রীদের মুখে শোনা গেলো ভয়ঙ্কর ব্লিজার্ড সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। ফলে অভিযান বাতিল করে নেমে আসতে হয়েছে।
পরবর্তী দুই দিনে লারকে পাস অতিক্রম করে অন্নপূর্ণা অঞ্চলের দারাপানি এলাকায় শেষ হলো ট্রেকিং। তার আগেই অবশ্য রচিত হয়েছে ইতিহাস। প্রথম কোনও বাংলাদেশি দল হিসেবে টিম লারকে মানাসলু সার্কিট সম্পন্ন করলাম আমরা।
ছবি: লেখক