বাংলার জমিদারদের অপার কীর্তি শশী লজ

IMG_20180920_104259ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামলকে বলা হয়ে থাকে জমিদার প্রথা বা জমিদার শাসনের স্বর্ণযুগ। সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে শশী লজ। এটি মূলত মহারাজা শশীকান্ত আচার্য্যের বাড়ি। ময়মনসিংহ রাজবাড়ি নামেও এটি পরিচিত। স্থানীয়ভাবে এই স্থাপনার আরেক নাম ‘বাতিঘর’। এটি শহরের কেন্দ্রস্থলে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত।

জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য্য অষ্টদশ শতকের শেষার্ধে ‘ক্রিস্টাল প্যালেস’ নামে একটি মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। ‘রংমহল’ নামেও এর পরিচিত ছিল। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে এটি ধ্বংস হয়ে যায়।

ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে একই স্থানে মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্যের উদ্যোগে বাইজেন্টাইন ধাঁচের নির্মাণশৈলীতে শশী লজের নির্মাণ শুরু হয়। তা শেষ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য্যের হাত ধরে ১৯০৫ সালে ভবনটি গড়ে ওঠে। তার নামানুসারে এর নামকরণ হয় ‘শশী লজ’। মহারাজ শশীকান্ত ১৯১১ সালে কিছু সংস্কারের মাধ্যমে এই বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধন করেন। তখন এটি হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর।

IMG_20180920_103341পুরো বাড়িটি ৯ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। শশী লজের মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই আছে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি। বিশাল প্রাসাদের পুরোটা জুড়ে মার্বেল পাথরে আবৃত। সব মিলিয়ে ১৮টি বিশাল ঘর। বসতঘর ছাড়াও আছে নাচঘর।

শশী লজের ভেতরে বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। এর একপাশে বিশ্রাম ঘর। তারপর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। তার পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত ফোয়ারা। ঠিক ওপরে ঝোলানো স্ফটিকের স্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি মুগ্ধকর। ভেতরে আধুনিক টয়লেট।

IMG_20180920_104311দোতলায় ওঠার জন্য দু’পাশে রয়েছে সিঁড়ি। এতে বিশেষ বাদ্যের ব্যবস্থা ছিল। সিঁড়িতে মানুষ পা রাখলেই সুমধুর বাজনা শোনা যেতো। জানা যায়, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে মহারাজা এক লাখ (মতান্তরে তিন লাখ) টাকা ব্যয়ে একটি স্ফটিকের সংগীত বাক্স কিনে এনেছিলেন। ভূমিকম্পের সময় সিঁড়িটি ভেঙে যায়। তখন জমিদার ছিলেন কলকাতায়। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, সংগীত বাক্স ধ্বংস হওয়ার কথা শুনে ভবন ভাঙার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছেন তিনি।

জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য্য ছিলেন সংস্কৃতিমনা। শশী লজের প্রতিটি কোণে তার সেই মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। মূল ভবনের সামনে বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্নানরত স্বল্পবসনা একটি মূর্তি। বলা হয়ে থাকে, এত বড় মার্বেল পাথরের মূর্তি দেশে আর কোথাও নেই!

IMG_20180920_103749মূল ভবনের ঠিক পেছনেই দুই ঘাট বিশিষ্ট একটি পুকুর দেখা যায়। এর একটি ঘাট কালের বিবর্তে ভেঙে গেছে। তবে কিছু কিছু ইট এখনও চোখে পড়ে। আর অন্যটি এখনও আগের মতোই রয়েছে। দ্বিতল এই ঘাট মার্বেল পাথরে আবৃত ছিল। কিন্তু এখন তা আধুনিক টাইলস দিয়ে ঢেকে দেওয়া। জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য্য ও তার পরের জমিদাররা এখানে বসে পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন। এই পুকুরেই জমিদারের স্ত্রী স্নানসহ অন্যান্য কাজ করতেন।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ১৯৮৯ সালে শশী লজকে সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর এখানে একটি জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু অদ্যাবধি শশী লজ অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এটি মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

IMG_20180920_104444যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে ময়মনসিংহে যাওয়া যায়। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার বাসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে। এনা ট্রান্সপোর্টের ভাড়া জনপ্রতি ২২০ টাকা আর সৌখিন পরিবহনের ভাড়া ১৫০ টাকা। এছাড়া কমলাপুর ও বিআরটিসি টার্মিনাল থেকে ঢাকা-নেত্রকোনা রুটের গাড়িতে চড়ে ময়মনসিংহে যেতে পারেন। বাস থেকে নামবেন মাসাকান্দা বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে অটো বা রিকশায় যেতে হবে শশী লজ বা ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে।

ট্রেনের ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে তিস্তা এক্সপ্রেস সকাল ৭টা ২০ মিনিটে ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছাড়ে। অগ্নিবীনা এক্সপ্রেস ঢাকা ছেড়ে যায় সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে। দুটোই আন্তঃনগর ট্রেন। এছাড়া মেইল ট্রেনেও যেতে পারেন। এগুলো হলো মহুয়া এক্সপ্রেস, দেওয়ানগঞ্জ এক্সপ্রেস, বলাকা এক্সপ্রেস ইত্যাদি।

IMG_20180920_102828যেখানে থাকবেন
ঢাকা থেকে গিয়ে শশী লজে ঘুরে একদিনেই ফিরে আসা যায়। তবে ময়মনসিংহের আরও কিছু জায়গায় ঘুরতে হলে থাকতে হবে হোটেলে। এক্ষেত্রে বেছে নিতে পারেন আমির ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল মুস্তাফিজ ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল হেরা, হোটেল সিলভার ক্যাসেল, হোটেল খাঁন ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া রয়েছে নিরালা রেস্ট হাউস, হোটেল ঈশা খাঁ, হোটেল উত্তরা, তাজমহল ইত্যাদি।
ছবি: লেখক