মিরপুর থেকে পরিচিত ট্যুর গ্রুপের সঙ্গে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসে আমাদের যাত্রা শুরু হয় রাত ১১টার দিকে। পরিচিত-অপরিচিত দুই ধরনের সদস্যই ছিল এই জার্নিতে। ফলে নতুন বন্ধুত্বের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
শীতের আমেজ ঢাকা শহরে তেমন একটা বোঝা না গেলেও শহরের প্রান্ত পেরোনোর আগেই ঠাণ্ডার প্রভাব টের পেতে থাকি। কিন্তু কুয়াশা ছাওয়া পথে গান বাজিয়ে নেচে-গেয়ে ঠাণ্ডাকে বশে রাো সহজ হয়েছে।
পেটপূজা করার জন্য ভালো একটা রেস্তোরাঁর খোঁজ চললো। ভালো রেস্তোরাঁ বলতে পাঁচতারকা জাতীয় কিছু নয়। আমাদের দলের সবাই ভ্রমণপ্রেমী। ফলে স্থানীয় খাবার খুঁজতে খুঁজতে আমরা পৌঁছে যাই শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে। রেলস্টেশন আর ট্রেন আমার বরাবরের ভালোবাসা। একবার ভেতরে ঘুরে এসে মনে হলো এখানে আর নতুন কিছু ঘটবে না। ঠিক তখনই আমাদের দলের চারজন ছেলে দৌড় শুরু করে স্টেশনের ভেতরের দিকে। আমিও তাদের পিছু নিলাম। তবে ওইভাবে দৌড়ে ভেতরে যাওয়ার পেছনের উদ্দেশ্য জানতাম না।
খিচুড়ি, গরুর ভুনা, দই ও চা দিয়ে মনভরে সকালের নাশতা সেরে আমরা পৌঁছে যাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই পার্ক ভানুগাছ রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্গত। ১৯৯৬ সালে উদ্যানটি ন্যাশনাল ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাক্টের অন্তর্ভুক্ত হয়। মূলত ট্রপিক্যাল গাছের এই অরণ্যের পরিবেশ বেশ উষ্ণ। বনের আবহ পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে হলে এর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত নিঃশব্দে হেঁটে যেতে হবে। তাই এটি পরিদর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। মানুষের তৈরি সোরগোল বন্যপ্রাণীদের দূরে সরিয়ে রাখে। তাই এক্ষেত্রে নীরবতার সঙ্গে কোনোরকম আপস করলে নিজেরই লোকসান।
অরণ্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, তাদের শান্তিতে থাকতে দিলে তবেই তারা দেখা দেয়। অযথা হৈচৈ করে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করবেন না। আর বনের যেকোনও ধরনের ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকুন। যেকোনও অরণ্যে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবসময় এসব বিষয় মাথায় রাখা ভালো।
পার্কের ভেতর ঢুকে অদ্ভুত সবুজের সমারোহ ও অরণ্যের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। অরণ্যের অন্যান্য অংশের কথা বলতে পারবো না, কিন্তু উদ্যানের ভেতরের ভূ-তল বৈচিত্র্যময়। কোথাও সমতল, কোথাওবা বালুর তৈরি ছোট ছোট টিলা। উঁচু-নিচু এই ভূ-তলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য ছোট ছোট হিম শীতল জলের স্রোতধারা। অরণ্যটির কোথাও কোথাও বেশ ঘন। এই ঘনত্ব এতটাই যে, সেইসব অংশ দুপুর ১২টার কড়া রোদেও অন্ধকার! চলতে চলতে বিভিন্ন ধরনের বর্ণিল মাকড়সা, পাখি, হনুমান, গিরগিটি বেশি নজরে এসেছে। এছাড়া এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়া একটি বেবুনের শরীরের অংশবিশেষ আমার চোখে পড়ে।
শীতকাল বলে আমরা কোনও সাপের দেখা পাইনি। কিন্তু এখানে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ আছে। তবে সাপের অবর্তমানে ডোবার ব্যাঙ দেখে আমাদের বেশ ভালোই লেগেছে। জলাশয়গুলো পারাপারের সময় একটু সাবধান থাকা শ্রেয়। কারণ শীতকাল হলেও আমাদের একজন সদস্যকে জোঁকে কামড়েছে। বর্ষায় এই পার্কের ভেতর জোঁকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা উদ্যানের শেষ মাথায় পৌঁছে যাই। শেষ প্রান্তে রয়েছে খাসিয়া উপজাতি অধ্যুষিত একটি এলাকা। এখানে বসতবাড়ি ছাড়াও আছে একটি চার্চ। পাহাড়ের চূড়ায় আছে খাসিয়া পুঞ্জি স্কুল। জরাজীর্ণ এই স্কুলে ছোট্ট উপজাতি গোষ্ঠীর বাচ্চাদের লেখাপড়া করানো হয়। এই উপজাতি বসতির শুরুতেই রয়েছে একটি মুদির দোকান। সেখানে হালকা নাশতার উপকরণ হিসেবে চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, কোমল পানীয়, পানি ইত্যাদি বিক্রি হয়।
স্থানীয় এক কিশোরের সহায়তায় আমরা চলে যাই ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে (নাম মনে নেই)। এখানে দুই দেশের সীমানার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীতে আমাদের দলের বেশ কয়েকজন দাপাদাপি করেছে। আমরা বাকিরা তীরের কাছে একটি বাঁশবাগানের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিই। সকালের নাশতা করা সেই হোটেলেই বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, মুরগির তরকারি আর ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করি। জার্নিতে আমার মোট খরচ ছিল দেড় হাজার টাকার মতো।
ছবি: লেখক