ট্রাভেলগ

একদিনেই লাউয়াছড়া উদ্যান, মাধবপুর লেক ও চায়ের রাজ্য শ্রীমঙ্গল বেড়ানো

23316330_10155911825025956_4019603790265000447_nসিলেট ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার প্রথম হয় ২০০৯ সালে। তাও একই বছরে দু’বার। তবুও যেন দেখার অনেক বাকি! এর আট বছর পর ২০১৭ সালে ফের সিলেট ভ্রমণে যাই। এবারও দু’বার। ওই বছরের নভেম্বরে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ বেশ মনে পড়ে। চা-বাগান, লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক ও মাধবপুর লেকে একদিনেই ঘুরে বেড়ানোর গল্পটা বলি।

মিরপুর থেকে পরিচিত ট্যুর গ্রুপের সঙ্গে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসে আমাদের যাত্রা শুরু হয় রাত ১১টার দিকে। পরিচিত-অপরিচিত দুই ধরনের সদস্যই ছিল এই জার্নিতে। ফলে নতুন বন্ধুত্বের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

শীতের আমেজ ঢাকা শহরে তেমন একটা বোঝা না গেলেও শহরের প্রান্ত পেরোনোর আগেই ঠাণ্ডার প্রভাব টের পেতে থাকি। কিন্তু কুয়াশা ছাওয়া পথে গান বাজিয়ে নেচে-গেয়ে ঠাণ্ডাকে বশে রাো সহজ হয়েছে।

22853354_10155881902400956_5332585458724384513_nমাঝপথে একবার চা-বিরতি দিয়েও ভোর ৫টার দিকেই শ্রীমঙ্গল পৌঁছে যাই। ঠাণ্ডা ছিল হাড়কাঁপুনি। সূর্যোদয়ের আগেই চা-বাগানের সামনে সাদা ধবধবে চা-কন্যার মূর্তির সঙ্গে ছবি তোলার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠি। এত ভোরে রাস্তা প্রায় ফাঁকাই ছিল। তাই আমরা মহাসড়কের মাঝে দাঁড়িয়েই বেশকিছু ছবি তুলেছি। চা-বাগানের ভেতরে কিছু গাছে কালো রঙের চঞ্চল কাঠবিড়ালী দলের খেলা দেখা ছিল বোনাস। ওদের ছোট্ট একটা ভিডিও বানিয়ে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।

পেটপূজা করার জন্য ভালো একটা রেস্তোরাঁর খোঁজ চললো। ভালো রেস্তোরাঁ বলতে পাঁচতারকা জাতীয় কিছু নয়। আমাদের দলের সবাই ভ্রমণপ্রেমী। ফলে স্থানীয় খাবার খুঁজতে খুঁজতে আমরা পৌঁছে যাই শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে। রেলস্টেশন আর ট্রেন আমার বরাবরের ভালোবাসা। একবার ভেতরে ঘুরে এসে মনে হলো এখানে আর নতুন কিছু ঘটবে না। ঠিক তখনই আমাদের দলের চারজন ছেলে দৌড় শুরু করে স্টেশনের ভেতরের দিকে। আমিও তাদের পিছু নিলাম। তবে ওইভাবে দৌড়ে ভেতরে যাওয়ার পেছনের উদ্দেশ্য জানতাম না।

সিলেট২ছেলেগুলো দৌড়ে একটি ট্রেনের ইঞ্জিনের ঠিক সামনের অংশে উঠে গেলো ছবি তোলার জন্য। কুয়াশা ফেঁড়ে নিরাপদে এগোনোর জন্য ইঞ্জিনের লাইট জ্বলছে। পায়ের ইনজুরির কথা ভেবে এক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্ত হলেও তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে আমিও উঠে পড়ি। পারিবারিকভাবে দেশের বড় ও আরেকটি উল্লেখযোগ্য রেলওয়ে জংশন আমার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবুও এমন কাজ করার কথা কখনও ভাবিনি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমার কল্পনাশক্তি, সাহস ও আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেয়।

খিচুড়ি, গরুর ভুনা, দই ও চা দিয়ে মনভরে সকালের নাশতা সেরে আমরা পৌঁছে যাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই পার্ক ভানুগাছ রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্গত। ১৯৯৬ সালে উদ্যানটি ন্যাশনাল ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাক্টের অন্তর্ভুক্ত হয়। মূলত ট্রপিক্যাল গাছের এই অরণ্যের পরিবেশ বেশ উষ্ণ। বনের আবহ পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে হলে এর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত নিঃশব্দে হেঁটে যেতে হবে। তাই এটি পরিদর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। মানুষের তৈরি সোরগোল বন্যপ্রাণীদের দূরে সরিয়ে রাখে। তাই এক্ষেত্রে নীরবতার সঙ্গে কোনোরকম আপস করলে নিজেরই লোকসান।

অরণ্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, তাদের শান্তিতে থাকতে দিলে তবেই তারা দেখা দেয়। অযথা হৈচৈ করে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করবেন না। আর বনের যেকোনও ধরনের ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকুন। যেকোনও অরণ্যে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবসময় এসব বিষয় মাথায় রাখা ভালো।

সিলেট১আমরা বেশ তাড়াতাড়িই ফটক খোলারও আগে উদ্যানের সামনে পৌঁছে যাই। টিকিট কাউন্টারের পাশে বিশ্রামের জন্য ছোট ছাউনি রয়েছে। তবে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে সময় কেটেছে আমাদের। ফলে উদ্যানের বাইরের অরণ্যের কিছুটা অংশও দেখা হলো। এমন সময় আমাদের চোখে পড়ে একজোড়া হনুমান। ওরা পার্কের বাইরে গাছের মাথায় ডাল ধরে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাচ্ছিল। এটা বোধহয় খেলা!

পার্কের ভেতর ঢুকে অদ্ভুত সবুজের সমারোহ ও অরণ্যের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। অরণ্যের অন্যান্য অংশের কথা বলতে পারবো না, কিন্তু উদ্যানের ভেতরের ভূ-তল বৈচিত্র্যময়। কোথাও সমতল, কোথাওবা বালুর তৈরি ছোট ছোট টিলা। উঁচু-নিচু এই ভূ-তলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য ছোট ছোট হিম শীতল জলের স্রোতধারা। অরণ্যটির কোথাও কোথাও বেশ ঘন। এই ঘনত্ব এতটাই যে, সেইসব অংশ দুপুর ১২টার কড়া রোদেও অন্ধকার! চলতে চলতে বিভিন্ন ধরনের বর্ণিল মাকড়সা, পাখি, হনুমান, গিরগিটি বেশি নজরে এসেছে। এছাড়া এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়া একটি বেবুনের শরীরের অংশবিশেষ আমার চোখে পড়ে।

শীতকাল বলে আমরা কোনও সাপের দেখা পাইনি। কিন্তু এখানে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ আছে। তবে সাপের অবর্তমানে ডোবার ব্যাঙ দেখে আমাদের বেশ ভালোই লেগেছে। জলাশয়গুলো পারাপারের সময় একটু সাবধান থাকা শ্রেয়। কারণ শীতকাল হলেও আমাদের একজন সদস্যকে জোঁকে কামড়েছে। বর্ষায় এই পার্কের ভেতর জোঁকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যায়।

23031143_10155895287365956_1780234134754648716_nলাউয়াছড়া উদ্যানের নাম লিখে ইন্টারনেটে খুঁজলে খুব জনপ্রিয় একটি অংশের প্রচুর ছবি পাওয়া যায়। সেটি হলো এই অরণ্যের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রেললাইন। কিছুক্ষণ পরপরই রেলপথটি দিয়ে ট্রেন চলাচল করে। বনের শান্ত ও নিঃস্তব্ধ পরিবেশে এটাই একমাত্র কোলাহলের উৎস। রেললাইনটি বিভিন্ন আলোকচিত্রীর চোখে বিভিন্নভাবে ধরা পড়েছে। আমরাও ইচ্ছেমতো ছবি তুলেছি। লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। এই উদ্যানের ভেতরে বসে বিশ্রাম নেওয়া ও হালকা চা-নাশতার জন্য টিলার ওপরে একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। এছাড়া আছে স্যুভেনির শপ।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা উদ্যানের শেষ মাথায় পৌঁছে যাই। শেষ প্রান্তে রয়েছে খাসিয়া উপজাতি অধ্যুষিত একটি এলাকা। এখানে বসতবাড়ি ছাড়াও আছে একটি চার্চ। পাহাড়ের চূড়ায় আছে খাসিয়া পুঞ্জি স্কুল। জরাজীর্ণ এই স্কুলে ছোট্ট উপজাতি গোষ্ঠীর বাচ্চাদের লেখাপড়া করানো হয়। এই উপজাতি বসতির শুরুতেই রয়েছে একটি মুদির দোকান। সেখানে হালকা নাশতার উপকরণ হিসেবে চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, কোমল পানীয়, পানি ইত্যাদি বিক্রি হয়।

সিলেটলাউয়াছড়া থেকে বেরিয়ে আমরা চলে যাই মাধবপুর লেকে। বেগুনি রঙের শাপলা ফুলের সমারোহ এই হ্রদকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এর প্রায় সবদিকেই রয়েছে চা-বাগান। দিনের শুরুতেই চা-বাগানে ঘুরে বেড়ানোর পর আমাদের ইচ্ছে ছিল, বাগানে কর্মরত নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আর নিজ হাতে চা-পাতা উত্তোলনের অভিজ্ঞতা অর্জন করা। কিন্তু সেটা এই জার্নিতে আর পূরণ করার সুযোগ ছিল না। তাই এখানে আমরা খুব বেশি সময় ব্যয় না করে পা বাড়াই।

স্থানীয় এক কিশোরের সহায়তায় আমরা চলে যাই ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে (নাম মনে নেই)। এখানে দুই দেশের সীমানার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীতে আমাদের দলের বেশ কয়েকজন দাপাদাপি করেছে। আমরা বাকিরা তীরের কাছে একটি বাঁশবাগানের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিই। সকালের নাশতা করা সেই হোটেলেই বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, মুরগির তরকারি আর ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করি। জার্নিতে আমার মোট খরচ ছিল দেড় হাজার টাকার মতো।

ছবি: লেখক