ট্রাভেলগ

শীতের লালাখালে পান্না সবুজ রঙ

1সিলেট শহর থেকে কারও লালাখাল যেতে ইচ্ছে হলে খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কেউ লোভাছড়া থেকে লালাখাল যেতে চাইলে বেশ বেগ পেতে হবে। তবে আমাদের কাজ সহজ হয়ে গেছে আগেই। আলমগীর তার সিএনজি নিয়ে সারাদিন আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হওয়ায় মুশকিল আসান সকালেই হয়ে গেছে।

লোভাছড়া থেকে দরবস্ত বাজার। সেখান থেকে তামাবিল হাইওয়ে ধরে কিছুদূর গেলেই সারিঘাট। শীত আর বর্ষায় এর রূপ আলাদা। সীমান্তের ওপার থেকে আসা সারি নদী প্রতি মৌসুমে রূপ বদলায়। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিও এই নদীতে নৌকা বাইতে ভয় পান। শীতে সারি নদীর নিস্তরঙ্গ নীল জলের অন্য এক সম্মোহনী আহ্বান। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই লালাখাল।

4সারি নদী থেকে লালাখাল আলাদা কিছু না। সারি নদীরই একটি অংশ লালাখাল। আমরা যাবো সেখানে। সারিঘাট থেকে নৌকায় লালাখাল হয়ে ভারত সীমান্তের জিরো পয়েন্টে পৌছাতে ৪০-৪৫ মিনিট লাগে। এজন্য পকেট থেকে বের করতে হবে দেড় হাজার টাকা।

আমরা সারিঘাট নয়, একেবারে লালাখালের ঘাটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। হাইওয়ে থেকে সাত কিলোমিটার ভেতরে জায়গাটি। বাসে বা গণপরিবহনে যেতে চাইলে অটোর ব্যবস্থা আছে। এটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। বিশেষ করে শীতে প্রচুর মানুষের ভিড় হয় এখানে। এত মানুষের আনাগোনার কারণ টের পাওয়া গেলো সারি নদীর পাশ ধরে চলতে চলতে। শীতের সময়ে এখানকার পানির রঙ পান্না সবুজ হয়। বিদেশের বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতের স্থিরচিত্রে আমরা এমন দৃশ্য দেখি। আমাদের দেশের খুব কম জায়গাতেই এ ধরনের দৃশ্যের দেখা মেলে। লালাখাল এর মধ্যে অন্যতম। এর তলদেশের মাটি ও পাড়ে চুনাপাথরের আধিক্যের কারণেই পান্না সবুজ রূপ ছড়ায়।

3ঘাটে পৌঁছালাম প্রায় মধ্যদুপুরে। এখন আর মিঠে রোদ নেই। বেশ তেতে আছে চারপাশ। নৌকা ভাড়া করে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত গিয়ে নদীর ঠাণ্ডা জলে গা ভেজাবো ঠিক করেছি। কিন্তু নৌকাঘাটেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। ঘাট থেকে জিরো পয়েন্ট মাত্র ৮-১০ মিনিটের দূরত্ব। অথচ প্রতি ঘণ্টা নৌকা ভাড়া ৬০০ টাকা। কী মুশকিল! এর কমে কেউ যাবে না। এই পথে যাওয়া-আসার ভাড়া কখনোই ৩০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত না। শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত কবুল করে জিরো পয়েন্টের উদ্দেশে রওনা দিতে হলো।

5মেঘালয়ের অজানা উৎস থেকে পাহাড়ি স্রোতস্বীনি এসে নেমেছে বাংলাদেশের ভাটির দেশে। সারি নদীর রঙিন জলে রোদের ঝিলিক। মাঘের দিনের মধ্যভাগে পাহাড়ি নদীটির বাঁকে বাঁকে জীবন জেগে উঠেছে। কী যেন এক জাদু আছে জায়গাটার! জংলা টিলা ছাপিয়ে দূরের আবছা সারি সারি পাহাড়ের আড়াল ভেদ করে কাঁটাতারহীন সীমান্ত পেরিয়ে এই দেশে সারি নদীর আগমন। মাঝে চুনাপাথুরে তলদেশ আর দুই পাড়ের ভূমিস্তরের সুবাদে সে ধারণ করেছে কোথাও সবুজ, কোথাও নীলের সহযোগে পান্না রঙের বাহার।

7জিরো পয়েন্ট গিয়ে হতাশ হতে হলো। দুরন্ত বেগে ওপার থেকে আসা স্রোত যেখানে নিস্তরঙ্গ হয়েছে, সেখানে আমাদের মনুষ্য প্রজাতির বদভ্যাসের চিহ্ন ভাসছে। চারদিকে। বিভিন্ন প্লাস্টিক দ্রব্য আর ময়লা-আবর্জনার মেলা বসেছে! এই জলে আর গোসল করার ইচ্ছা জাগলো না।
আরেকটু পিছিয়ে নৌকা পাড়ে ভেড়ানো হলো। এই মধ্যদুপুরে জড়তা ঝেড়ে ছেলে-বুড়ো-নারী আর তাদের পোষ্যরা ঝাঁপিয়ে তোলপাড় করছে নিস্তরঙ্গ জলধারা। আমরাও দুপুরের বাড়ন্ত রোদের সুযোগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাল খুঁজছি। একসময় সাহসটুকু করেই ফেললাম। কিন্তু গোঁড়ালি থেকে হাঁটু হয়ে বুক পর্যন্ত জলে নামতেই সূর্যের তাপ যেন ভোজবাজির মতো উবে গেলো। মাইনাস ডিগ্রি সেলসিয়াসের ছোট ভাই টাইপের ঠাণ্ডা জলশরীর কেটে কেটে নিচ্ছে। নতুন এক ফন্দি আঁটলাম।
2অন্যরা তীরে খানিকটা কসরত করে শরীর গরম করে একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমিও জল তোলপাড় করতে করতে পড়লাম ঝাঁপিয়ে। শরীর আর মন জুড়িয়ে গেলো নিমিষে। গত ক’দিনের শীতের দাপটে শরীর জলস্পর্শহীন ছিল কিনা!

গোসলের পর ক্ষিদে চাগিয়ে উঠলো। ঘাটেই একটি হোটেলে সেরে নিলাম দুপুরের খাবার। এখানে এসে খেতে চাইলে অবশ্যই আগে দামদর করে নেওয়া ভালো। 
6আবারও নৌকা ভাড়া করে ১০-১৫ মিনিট দূরে ভারত সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে ঘুরে এলাম। নৌকা থামিয়ে পড়ন্ত সূর্যের হারিয়ে যাওয়া অবধি চুপ করে বসে চারপাশ ভেতরের ক্যামেরায় গেঁথে নিলাম। শেষ বেলায় পাখিরা নীড়ে ফিরছে। নদীর স্রোতের কিন্তু বিরাম নেই। আমরা ফিরে এলাম পথচলার নিয়ম মেনে।

50247520_775534572797005_2404315966382014464_nপ্রয়োজনীয় তথ্য
লালখালে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় শীতকাল। বর্ষার পাহাড়ি ঢল নামলে পানিতে রঙের মেলা হারিয়ে যায়। সিলেট শহরের ধোপাদীঘির পাড় থেকে জাফলংগামী হিউম্যান হলারে চলে যান জৈন্তাপুর উপজেলার সারিঘাটে। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। ভাড়া ৪০ টাকা। এছাড়া শহরের কমদতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস পাওয়া যাবে। আর আধাবেলার জন্য সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করলে খরচ পড়বে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকার মতো।

ছবি: লেখক