শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখির আগমন ঘটে নীলসাগরে। এ সময় পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে সবুজ বৃক্ষরাজিতে শোভিত জায়গাটি। পাখির কিচিরমিচির আর জলে ডানা ঝাপটানোর শব্দ নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
জানা গেছে, শীতের শুরু থেকে নীলসাগরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে অতিথি পাখিরা এসে ভিড় করেছে। অন্তত ৬৫টি প্রজাতির কয়েক হাজার পরিযায়ী রয়েছে। মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত তারা থাকবে।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, অতিথি পাখিদের যাতে কেউ শিকার করতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের জন্যই মূলত নীলসাগর জনপ্রিয়। ১৯৯৯ সালে এই এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। এখন বিনোদন কেন্দ্রটিকে পর্যটন বিভাগের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
দীঘির চারদিকে রয়েছে নারিকেল, বন বাবুল, আকাশমনি, লতাগুল্ম, দেবদারুসহ অজানা-অচেনা হরেকরকম ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি। এছাড়া পাশে রয়েছে একটি ছোট পার্ক। নীলসাগরের পাড়বেষ্টিত এলাকায় রয়েছে শিশুদের জন্য চড়কি, দোলনা, ঘোড়ার গাড়ি, সাঁতারের নৌকা।
নীলফামারীর পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুর, পঞ্চগড়, তেতুলিয়া ও রংপুরের বিভিন্ন ভ্রমণপিপাসুরা রেলপথ ও সড়কপথে বেড়াতে আসেন নীলসাগরে। তাদের সুবিধার্থে রয়েছে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত দুটি বিলাসবহুল আবাসিক হেটেল।
নীলসাগরে প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারুনী স্নান ও মেলা বসে। এই আয়োজনে গ্রামীণ পণ্যসহ হস্তশিল্প, কারুশিল্প, বাঁশ ও কাঠের আসবাবপত্রসহ হরেক রকমের পণ্য পাওয়া যায়।
স্কুল শিক্ষক সুরেস চন্দ্র রায় বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, একসময় রেওয়াজ ছিল— গাভীর প্রথম দুধ এই দীঘির পানিতে দিলে গাভীর কাছ থেকে বেশি পরিমাণ দুধ পাওয়া যেত। রেওয়াজ অনুযায়ী মালিকরা প্রথম গাভীর দুধ দীঘিতে ঢেলে না দিলে কাউকে খেতে দিতেন না। কারণ দুধ বেশি পাওয়ার আশায় তারা দূরদূরান্ত থেকে এখানে আসতেন। সেই বিশ্বাস থেকে এখনও এখনও গ্রামের মানুষ গাভীর প্রথম দুধ নীলসাগরের পানিতে ঢেলে দেয়। এছাড়া বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দীঘির পাড়ে পূজা-পার্বণ করে।
উত্তর-দক্ষিণে লম্বা নীলসাগর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে বহু উপাখ্যান ও রূপকথা। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে জলাশয়টির খনন শুরু হয়েছিল। কথিত আছে, তৎকালীন বিরাট রাজা বসবাস করতেন এখানে। তার বিপুলসংখ্যক গবাদি পশু ছিল। এগুলোকে গোসল ও পানি খাওয়ানোর জন্য একটি দীঘি খনন করান তিনি। রাজার নামানুসারের এর নামকরণ হয় ‘বিরাট দীঘি’। কালের বিবর্তনে রাজার একমাত্র মেয়ে বিন্নাবতীর নামানুসারে এটি ‘বিন্না দীঘি’ নাম ধারণ করে। ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সচিব এমএ জব্বার এই দীঘিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত করতে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালে নীলফামারী জেলার নামানুসারে এর রাখা হয় ‘নীলসাগর’।
নীলফামারীতে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পাঁচটি সারাদেশে জনপ্রিয়। এগুলো হলো নীলসাগর, তিস্তা ব্যারাজ, নীলকুঠির, চিনি মসজিদ ও কুন্দুপুকুর মাজার। এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। এছাড়া জেলায় ছোটবড় সব বয়সীদের ঘুরে দেখার মতো আরও আছে ভিমের মায়ের চুলা, পাল রাজার বাড়ি, হরিশ্চন্দ্র রাজার বাড়ি, ধর্মপালের গড়।