ভ্রমণপিপাসুদের অনেকের কাছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এপ্রিল মাস বেশ উপযোগী। এই সময় গন্তব্য অনুযায়ী তুলনামূলক কম খরচে ছুটি কাটানো যায়। সেজন্য হোটেল, এয়ার টিকিট, গাড়ি ভাড়া আগেভাগে চূড়ান্ত করে ফেলা ভালো। যদিও ঝড়-বৃষ্টিসহ এপ্রিলের আবহাওয়া নিয়ে আগে থেকে কিছু বলা যায় না! গন্তব্যের ওপর নির্ভর করে আবহাওয়া কেমন থাকবে। পরিবার কিংবা কাছের মানুষদের নিয়ে এপ্রিলে ঘুরে বেড়ানোর সেরা পাঁচটি জায়গার কিছু তথ্য জেনে নিন।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’ গ্রন্থের ‘পারী’ অর্থাৎ প্যারিস পৃথিবীর সুন্দরীতমা শহরের তালিকায় অন্যতম। ফ্রান্সের রাজধানী সারাবছরই জ্বলজ্বলে। তবে বসন্তকালে বিশেষ মুগ্ধতা ছড়ায় সেখানে। এপ্রিলের মাঝামাঝি শহরটিতে বৃষ্টির পরিমাণ কমে আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ হতে শুরু করে। তাই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তিন ধরনের আবহাওয়ার উপযোগী প্যাকিং করাই উত্তম।
প্যারিসে আইফেল টাওয়ারের আশেপাশে মন রঙিন করে দেওয়া ফুল ফোটে এপ্রিলে। শিল্পপ্রেমীরা চাইলে এ মাসে ঘুরে আসতে পারেন গ্র্যান্ড প্যালেতে। সেখানে কাচের সিলিংয়ের নিচে ৪ থেকে ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে ‘আর্ট প্যারিস আর্ট ফেয়ার’। এই আয়োজনে শতাধিক গ্যালারি সমকালীন চিত্রকলার পসরা নিয়ে সমবেত হবে। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল ও মহাদেশের শৈল্পিক কীর্তি বিশেষ ফোকাস পেয়ে থাকে এতে।
১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্র্যান্ড মস্ক অব প্যারিসে রয়েছে চোখজুড়ানো সবুজের সমারোহ। বর্ণনাতীত সৌন্দর্যমণ্ডিত পেরে লেশেজ সমাধিক্ষেত্রে চিরশায়িত আছেন অস্কার ওয়াইল্ড, এডিথ পিয়াফ ও জিম মরিসনের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা।
সুদৃশ্য স্থাপত্যশিল্প, সুস্বাদু জাপানি খাবার ও গেইশা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে বছরের যেকোনও সময়ে কিয়োটোতে ভ্রমণের জুড়ি নেই। তবে জাপানের এই ঐতিহাসিক শহরে এপ্রিলের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত চেরি ফুলের প্রাচুর্যে হারিয়ে যাওয়া যায়।
গিয়ন ছাড়াও কিয়োটোর অন্যান্য গেইশা প্রধান অঞ্চলগুলোতে এপ্রিলে মনোরম গেইশা নৃত্য উপভোগ করা যায়। এই নিরবধি সৌন্দর্য বারবার দেখতে ইচ্ছে করবে!
পূর্ব এশিয়ার বাইরের দেশগুলোর ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য কিয়োটোতে যাওয়া দীর্ঘ যাত্রার ব্যাপার। এজন্য অ্যালকোহল, ক্যাফিনযুক্ত পানীয় ও লবণাক্ত খাবার এড়িয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করলে ভালো।
অস্টিন ও সান অ্যান্টোনিও, টেক্সাস (যুক্তরাষ্ট্র)
আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে গ্রীষ্মকাল আগেভাগে দেখা দেয়। এর সুবাদে শহরটি হয়ে ওঠে ভ্রমণ উপযোগী। এপ্রিলে সেখানে থাকে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। পাহাড়ি এলাকা টেক্সাসে পর্যটক প্রিয় দুটি স্থান হলো অস্টিন ও যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ১০ শহরের মধ্যে অন্যতম সান অ্যান্টোনিও। অস্টিন ও এর চেয়ে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত সান অ্যান্টোনিওতে ভ্রমণপিপাসুরা দুই ধরনের স্বাদ পান।
জ্যাজ, ব্লুজ ও ব্লুগ্রাস সংগীতানুরাগীদের জন্য জুতসই অস্টিনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ডেলের কাছে আগামী ১১ থেকে ১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য ওল্ড সেটলারস সংগীত উৎসব। পর্যটকরা চাইলে সেখানে ক্যাম্পিং করতে পারেন।
নিজেদের অদ্ভুত আয়োজনগুলো নিয়ে গর্ব করে অস্টিনবাসী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য ইওজ বার্ষিক জন্মদিনের পার্টি। এতে থাকে অ্যাক্রোব্যাটস, ড্রাম সার্কেল, কস্টিউম প্রতিযোগিতা।
মার্চের শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অস্টিনের অ্যান ডব্লিউ.রিচার্ডস কংগ্রেস এভিনিউ ব্রিজের পাদদেশে গেলে লাখ লাখ বাদুরের উড়ে যাওয়ার অভাবনীয় দৃশ্য দেখার সুযোগ মেলে।
টেক্সাসে রোদ্দুর উপভোগের দারুণ জায়গা জিলকার পার্ক। সেখানকার মনোরম প্রাকৃতিক জলাশয় বার্টন স্প্রিংসের ঝকঝকে জল তৃপ্তি এনে দেয় স্থানীয় ও পর্যটকদের।
শহরটির সাউথ কংগ্রেস এভিনিউর গুয়েরো’স ট্যাকো বারে খেয়ে ভোজনবিলাসীরা কন্টিনেন্টাল ক্লাবের পথ ধরে হাঁটলে সুরেলা গান ভেসে আসবে। হোটেল সান হোসে রাতে থাকলে তো কথাই নেই। সারারাত ভাসবেন সুরের সাম্পানে!
এপ্রিলে টেক্সাস হিল কান্ট্রিকে প্রাণবন্ত রাখে নীল রঙা বুনোফুল। সেখানে বসন্তের শোভা উপভোগের জন্য লেডি বার্ড জনসন ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার সেন্টার দারুণ।
সান অ্যান্টোনিওর বিভিন্ন ভেন্যুতে আগামী ১৮ এপ্রিল থেকে শুরু হবে ফিয়েস্তা। পার্টি চলবে ২৮ এপ্রিল অবধি। এতে থাকবে বৈচিত্র্যময় খাবার, ফ্যাশন শো, লাইভ মিউজিক, সেনা প্যারেড। গত ১ এপ্রিল শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী ভ্যালেরো টেক্সাস ওপেন শীর্ষক গলফ টুর্নামেন্ট। সান অ্যান্টোনিও বই উৎসব রয়েছে ৬ এপ্রিল। পোটিট শহরে ৫ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত রয়েছে স্ট্রবেরি উৎসব।
মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে কোস্টারিকা ও পানামার চেয়ে পর্যটক তুলনামূলক কম নিকারাগুয়ায়। তাই ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে বেড়ানোর জন্য দেশটি জুতসই। নিকারাগুয়ার আটলান্টিক মহাসাগরমুখী অংশের আবহাওয়া এপ্রিলে বেশ আর্দ্র ও বর্ষণমুখর হয়ে থাকে। ফলে সেখানকার ল্যান্ডস্কেপ দেখতে আকর্ষণীয় লাগে। সবখানে ঊষ্ণ আবহাওয়া থাকলেও পাহাড়গুলো এ সময় কিছুটা শীতল মনে হবে।
ইতিহাসপ্রিয় ও স্থাপত্যপ্রেমীরা লেক মানাগুয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি লিয়নে যেতে উন্মুখ থাকেন। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যাথেড্রাল অব লিয়ন’ মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে বড় গির্জা। ২০১১ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করা হয়।
মধ্য আমেরিকায় প্রথমবার বেড়ানোর ক্ষেত্রে ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র, ভ্রমণের রোডম্যাপ ও জরুরি যোগাযোগের তথ্যের বাড়তি ফটোকপি সঙ্গে রাখলে ভালো। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে এসব ভাগাভাগি করা যেতে পারে। মূল কপি হারিয়ে গেলেও তাতে অসুবিধা হবে না।
মরক্কো
পৃথিবী ও অন্যান্য পশ্চিমা সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রেমময় স্থানের মধ্যে মরক্কো অন্যতম। স্পেনের জিব্রাল্টার পেরিয়ে অবস্থিত দেশটি। ফলে ইউরোপ থেকে অনায়াসে যাওয়া যায় সেখানে। এপ্রিলে বেশ উষ্ণ হতে শুরু করে মরক্কো। পাহাড়-পর্বত আর মরুভূমির অসাধারণ সংমিশ্রণে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া প্রত্যাশা করা ভালো সেখানে। এর মধ্যে বৃষ্টি বিরল। তবে রাত থাকে শীতল।
মারাকেশে এপ্রিলে দর্শনীয় হয়ে ওঠে এমন কয়েকটি স্থানের কথা বলা যাক। ফুলবাগান জর্দান মেজোরেলে দেখা যায় বিভিন্ন দুর্লভ ফুল। ষোড়শ শতকে নির্মিত সুলতানের প্রাসাদ ‘এল বদি প্যালেস’ জরাজীর্ণ হয়ে পড়লেও পর্যটকদের নজর কাড়ে।
মারাকেশ ছাড়াও মরক্কোতে আরও কিছু দর্শনীয় জায়গা আছে। বন্দরনগরী ট্যাঞ্জিয়ার্সের ক্যাফে সংস্কৃতি ভ্রমণপ্রেমীদের বেশ পছন্দের। ক্যাসাব্লাঙ্কা শহরে রয়েছে সমুদ্রতীরবর্তী দ্বিতীয় হাসান মসজিদ। আফ্রিকার বৃহৎ ও বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত মসজিদগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। সেখানে একসঙ্গে ২৫ হাজার মানুষ অবস্থান করতে পারে। অমুসলিমদের জন্যও এই মসজিদ উন্মুক্ত। আটলান্টিক মহাসাগরের সুবাদে দ্বিতীয় হাসান মসজিদ বেশ দর্শনীয়।
পোশাকের বেলায় মরক্কোতে হালকা ওজন ও বিনয়ী দেখাবে এমন কিছু বেছে নিলে ভালো। যেমন লম্বা প্যান্ট ও কলারের জামা। নারীদের জন্য লম্বা স্কার্ট কিংবা প্যান্ট ও কামিজ সবচেয়ে উপযুক্ত। মসজিদ কিংবা পবিত্র স্থানে যেতে নারীদের হাতের কব্জি ও গোড়ালি ঢাকা পোশাক আর স্কার্ফ কিংবা হিজাব দিয়ে চুল ঢেকে নিতে হবে। মসজিদে জুতা পরে ঢোকা যায় না। তাই জুতা রাখার জন্য ব্যাকপ্যাক কিংবা ব্যাগ থাকা সুবিধাজনক। নীরবতা পালনও আবশ্যকীয়, বিশেষ করে শুক্রবার বিকালে।
সূত্র: সিএনএন