রাজধানীর কোলাহল থেকে একটু দূরে বসিলা সেতু পেরিয়ে ডান দিকে ওয়াশপুর গার্ডেন সিটি। বুড়িগঙ্গা নদীর কোলঘেঁষে কেরানীগঞ্জ উপজেলার অধীন এই এলাকার ৬ নম্বর রোডে প্রায় ৭ কাঠা জায়গায় অবস্থিত ‘লিডো পিস হোম’। লিডোর পুরো রূপ হলো লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। সুবিধাবঞ্চিত ও ভাগ্যাহত পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক উন্নয়নধর্মী প্রতিষ্ঠান এটি। এর প্রতিষ্ঠাতা ফরহাদ হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে নিরলস প্রচেষ্টায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করছেন তিনি।
প্রকৃতিবান্ধব খেলার জায়গার বড়ই অভাব রাজধানীতে। তাই বছর দুয়েক আগে পরিবেশবান্ধব খেলার জায়গা তৈরির একটি প্রকল্প হাতে নেয় গবেষণাধর্মী স্থাপত্য শিল্পের প্রতিষ্ঠান ‘পারা’। এর অংশ হিসেবে পিস হোমের পাশেই তিন বছরের জন্য ওয়াশপুর গার্ডেন সিটি কর্তৃপক্ষের দেওয়া জায়গায় গড়ে তোলা হয় বাঁশের তৈরি একটি খেলার জায়গা। এর নাম ‘ব্যাম্বু প্লে-স্পেস’। সেই প্রকল্প ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে কয়েকটি পুরস্কার জয়ের পাশাপাশি প্রশংসিত হয়েছে। অস্থায়ী তবে নান্দনিক এই প্রকল্পে সঙ্গে ছিল বুয়েট, ব্র্যাক ও শাবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষার্থী ও পারা’র স্থপতিরা।
পথশিশু ছাড়াও খেলার জায়গাটি সাধারণ শিশুদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে রয়েছে স্পাইডার নেট, কৃত্রিম ক্লাইম্বিং বেল, দোলনা ইত্যাদি। এছাড়া এর ভেতরে একটি গ্যালারিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা যায়।
সোহেল রানার কথায়, ‘শিশুরা ক্লাইম্ব করতে চায়, বাঁশে দোলনার মতো ঝুলতে চায়। এসব ভেবেই ক্লাইম্বিং ওয়াল, স্পাইডার নেট, দৌড়াদৌড়ি করার জায়গা রাখা হয়েছে এখানে। স্পেশাল বাচ্চারা যেন হুইল চেয়ারে করে উঠতে পারে সেই ব্যবস্থাও আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে আশেপাশের সাধারণ শিশুরাও এসে খেলছে। এতে করে তাদের মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি হচ্ছে।’
প্রথমবারের মতো আয়োজিত স্ট্রিট চিলড্রেন ওয়ার্ল্ড কাপে অংশ নিয়েছে লিডো পিস হোমের ৮ শিশু। তারা হলো সানিয়া মির্জা, জেসমিন আক্তার, স্বপ্না আক্তার, আরজু রহমান, রাসেল ইসলাম রুমেল, আবুল কাশেম, রুবেল ও নিজাম হোসেন। গত ৩০ এপ্রিল থেকে ৮ মে লন্ডনে পথশিশুদের এই ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়।
লন্ডনের স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড এই বিশ্বকাপের আয়োজন করে। এতে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ডসহ ১০টি দেশের ৮০ পথশিশু অংশ নিয়েছে। সব দেশ থেকে চারজন মেয়ে ও চারজন ছেলে শিশুকে নির্বাচিত করা হয়। গ্রুপ পর্বের প্রথম দিনে মরিশাস ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে শুভ সূচনা করেছিল বাংলাদেশ। দিনের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ ভারতের কাছে হেরে একটু পিছিয়ে পড়েছিল রুবেল-সানিয়ারা। দ্বিতীয় দিনে ইংল্যান্ড ও তানজানিয়ার কাছে হেরে গেলেও উত্তর ভারত ও নেপালের বিপক্ষে দুটি জয় সেমিফাইনালে নিয়ে যায় তাদের।
ঢাকার আজিমপুরে বেড়ে উঠেছেন ফরহাদ। পথের ধারে ছোট শিশুদের দেখে ভীষণ মায়া হয় এই তরুণের। কলেজে পড়ার সময় থেকে ভাগ্যাহত শিশুদের জড়ো করে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামের স্কুল বানিয়ে পড়াতেন তিনি। এভাবে আরও বড় দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছে হয় তার। সেখান থেকে লিডো পিস হোমের ভাবনা আসে। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে এটি।
ফরহাদ জানান, প্রতি মাসে পিস হোমের পথশিশুদের নামের তালিকা রাজধানীর থানাগুলোতে পাঠানো হয়। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে তার শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কেউ লালনপালন করতে চাইলে তারাও নিরাশ করেন না। প্রতিটি শিশুর জন্য তৈরি করা হয় আলাদা ফাইল। শিশু পাওয়ার পর থেকে ছয় সপ্তাহ তার মা-বাবাকে খুঁজতে চেষ্টা চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া না গেলে তাদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন