হাজারদুয়ারি প্রাসাদ নবাব আর ব্রিটিশদের বিচারালয় হিসেবেও ব্যবহার হতো। বিচারকার্য পরিচালনার সময় কেউ যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বিচারপ্রার্থীদের বোকা বানাতে ও শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে একহাজার দরজার মধ্যে ১০০টি নকল রাখা হয়। বাকিগুলো একটি চাবি দিয়েই খোলা ও বন্ধ করা যায়।
ভাগীরথী নদীর তীরে ১২ বিঘা জমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৮০ ফুট উচ্চতার হাজারদুয়ারি প্যালেস। বর্তমানে ভারত সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে এটি। এর বর্তমান নাম হাজারদুয়ারী প্যালেস মিউজিয়াম।
প্রাসাদটি তিনতলা। একতলায় অস্ত্রাগার, অফিস-কাছারি ও রেকর্ড রুম। অস্ত্রাগারে মোট ২ হাজার ৬০০টি অস্ত্র আছে। বর্তমানে এই জাদুঘরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা মুহাম্মদী বেগের অস্ত্র, পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত মীর মর্দনের কামানসহ অনেক অস্ত্র, প্রজাবৎসল নবাব আলীবর্দীর ব্যবহৃত তলোয়ার ও বহুনল বিশিষ্ট বন্দুক, মীরকাসিমের ছোরা, নাদির শাহের মাথার বর্ম, বিভিন্ন ধরন ও আকারের কামান, বিভিন্ন ধরনের ছোরাসহ দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে এখানে।
একতলা প্যালেসের সামনের বিশাল সিঁড়িটি দরবার পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনে লম্বা গোলাকার স্তম্ভে সুন্দর নকশার কাজ রয়েছে। সিঁড়ির দু’পাশে দুটি সিংহ মূর্তি ও দুটি ছোট সেলামি কামান। তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা। দোতলা ও তৃতীয় তলায় আর্ট গ্যালারি ও লাইব্রেরি। গ্যালারিতে বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর চিত্রকলা আছে এখানে। লাইব্রেরিতে রয়েছে বহু ধর্মপুস্তক, চুক্তিপত্র, নাটক, উপন্যাস, তাম্রলিপি, ইতিহাস, প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ, বিদেশি ভাষার গ্রন্থ ইত্যাদি। সম্রাট আকবরের সময়কার আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরির পাণ্ডুলিপি ও বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন অর রশিদের হস্তলিখিত কোরআন শরীফ রয়েছে এখানে। এছাড়া আছে নবাব আর ইংরেজদের ব্যবহৃত বহু অস্ত্র, বাসন, আসবাব, বহু বিখ্যাত শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবি।
এই গাইডের ভাষ্য, ‘অনেক পর্যটকের ধারণা, হাজারদুয়ারি প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাউদ্দৌলা। কিন্তু তার মৃত্যুর প্রায় ৮০ বছর পর মীর জাফরের পঞ্চম বংশধর নবাব হুমায়ুনজা এটি স্থাপন করেন। সিরাজের প্রাসাদের নাম ছিল হীরাঝিল। পরে তা ভাগীরথী নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
প্যালেসের সামনে রয়েছে মনোরম বাগান। এর পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী। হাজারদুয়ারির ভেতরে মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া বারণ। কারও কাছে এগুলো থাকলে সরকারিভাবে টোকেন দিয়ে জমা নেওয়া হয়। হাজারদুয়ারি শুক্রবার বন্ধ থাকে। প্রবেশ মূল্য ১০ রুপি।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস
মুর্শিদাবাদের নাম ছিল মাকসুদাবাদ। মোগল সুবেদার মুর্শিদ কুলি খান ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মাকসুদাবাদে স্থানান্তর করেন। তিনিই বাংলার প্রথম নবাব। তার নামানুসারে মুর্শিদাবাদের নামকরণ হয়। নবাবি আমলে বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। এটি নবাবি আমলের ঐতিহাসিক এলাকা। শুধু নবাব নয়, মীর জাফরসহ ইতিহাসের খলনায়কদের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে এখানে। তাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই শহরে বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সমাগম হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেকে ইতিহাস ও নবাবি আমলের বিভিন্ন স্থাপনা দেখতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস ঐতিহ্যবাহী জেলা মুর্শিদাবাদে ভিড় করেন।
মুর্শিদাবাদের আকর্ষণ
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ (মিউজিয়াম), বড়া ইমামবরা, বাচ্চাওয়ালী তোপ, ঘড়িঘর, চক মসজিদ, ত্রিপোলি গেট, খোশবাগ, কাটরা মসজিদ, মতিঝিল, নসিপুর প্রাসাদ, কাঠগোলা বাগানবাড়ি, কাশিমবাজার রাজবাড়ি, ওসেফ মঞ্জিল, জগৎ শেঠের বাড়ি, নশীপুর রাজবাড়ি, নশিপুর আখড়া, মীর জাফরের বাড়ির গেট, জাফরাগঞ্জ সমাধি, আজিমুন্নেসা বেগমের সমাধি, হলুদ মসজিদ, ফুটি মসজিদ, জাহান কোষা কামান, উনিচাঁদের মন্দির, রাধামাধব মন্দির, ইংরেজ সমাধি, সুজাউদ্দিনের সমাধি, মীরমদনের সমাধি পলাশী, আস্তাবল ইত্যাদি।
যেভাবে যাবেন
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৯৮ কিলোমিটার দক্ষিণে ও কলকাতা থেকে ২০৯ কিলোমিটার উত্তরে মুর্শিদাবাদ। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেন বা এক্সপ্রেসে লালগোলা, হাজারদুয়ারি ও ভাগীরথীতে যাওয়া যায়। লোকাল ট্রেনে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মুর্শিদাবাদের ভাড়া ৪৫ টাকা। সড়ক পথে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে বা শিলিগুড়ি মালদা বাসে চড়ে প্রথমে বহরমপুর ও পরে বাস, রিকশা, অটোরিকশা, জিপ ভাড়া করে মুর্শিদাবাদ যেতে হবে।