ফাঁকে ফাঁকে শাপলা। লাল, সাদা। কোনোটা ফুটছে। কোনোটা আবার পুরোপুরি ফুটে বিলের জলে মেলে রেখেছে নিজেকে।
এখানে ওখানে জাল পাতা। মাছ তুলে খলুইয়ে ভরছেন নিঃসঙ্গ মাঝি।
দ্বীপ গ্রামের পাশে পানিতে দাপিয়ে চলেছে ন্যাংটো শিশুর দল। সাঁতরে এসে ইঞ্জিন নৌকায় উঠছে। গলুইয়ের ওপর উঠে লাফিয়ে পড়ছে ফের। বাড়ির ঘাটে গেরস্থালি সারছে বউ, মেয়েরা। গরু নিয়ে গৃহস্থ নেমেছে বেলাই বিলে। প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জলাশয় কয়েক শতাব্দী ধরে বুকে আগলে রেখেছে বালু নদীকে।
ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থে যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, ‘চারিশত বৎসরের পূর্বে এই বিলমধ্যে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব ছিল না। তৎকালে এই বিলটি একটি খরস্রোতা স্রোতস্বিনীরূপে বিরাজমান ছিল।’
স্থানীয় এক ভাটের গানে বেলাই বিলের জন্ম বিষয়ে এক প্রবাদে বলা হচ্ছে–
‘নানা স্থানে স্থানে শুভক্ষণে পুষ্কর্ণি কাটিল/বেলাই বিল শুষ্ক করি নিজ প্রতাপ দেখাইল।’
এই প্রতাপ দেখানো লোকটি হলেন খটেশ্বর ঘোষ। তিনি তখন ভাওয়ালের ভূস্বামী। এই স্রোতস্বিনীর খরস্রোতে তার এক ছেলে ভেসে যায়। খটেশ্বর তখন ৮০টি খাল কেটে নদীজল নিঃশেষ করে ফেলেন। তাতে খরস্রোতের প্রণালি পরিণত হয় প্রকাণ্ড বিলে।
গোটা বিলেই পাখির বিচরণ। বাজ, চিল, বক, মাছরাঙার মেলা। পাশ ঘেঁষে নৌকা গেলেও খুব একটা গা করছে না শিকারি পাখিগুলো। গরুর জন্য নৌকা বোঝাই কচুরিপানা নিয়ে ফিরছে মাঝি। একই অঙ্গে কত যে রূপ মেলে আছে বেলাই!
এ বিলের পূর্ব অংশে বক্তারপুর গ্রাম। যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, এ স্থানেই ঈসা খাঁ বাস করতেন। জনশ্রুতি বলছে, ঈসা খাঁ যখন এ স্থানে থাকতেন, তখন তার সঙ্গে থাকতো অনেক বজরার বহর। ওই বজরা থেকে জায়গার নাম হয় ‘বজরাপুর’ বা ‘বজ্রাপুর’। কালের বিবর্তনে তা ‘বক্তারপুর’ রূপ নেয়। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বক্তারপুরে অসুস্থ ঈসা খাঁ’র মৃত্যু হয়।
ওখান থেকে বেলাই বিলে বৈঠা ঠেলে অল্প সময়েই বালুর প্রবাহে চলে আসা যায়। উজানে কাপাসিয়ার কাছে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে সংযোগ গড়া সুতী নদী এখন প্রায় মৃত। শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর মধ্যবর্তী অববাহিকার সব পানি মূলত বেলাই হয়েই বালুতে নামে। এখনও বারো মাসই নাব্য থাকে বালু নদী।
একটু ভাটিতে ঈসাপুরা বাজার। নদীর ওপরে লোহার সেতু। আরও ভাটিতে বালু থেকে একটা শাখা এগিয়েছে পশ্চিমে। একটু এগিয়ে যার নাম হয়েছে রামপুরা খাল, আরও সামনেরটা এখনকার হাতিরঝিল। একসময় এর নাম ছিল নড়াই নদী। জেমস রেনেলের মানচিত্রে যা ‘নেড়ি খাল’ নামে চিহ্নিত। ওই নড়াই ত্রিমোহিনীতে যেখানে বুড়িগঙ্গামুখী দেব ধোলাইয়ের জন্ম দিয়েছে, সেখান থেকে বালু নদীর দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত নৌকা চলে এখনও।
এখান থেকে যত ভাটিতে নেমেছে, বালু অববাহিকায় হাউজিং কোম্পানির সাইনবোর্ড ততই বেড়েছে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় বালু থেকে বের হওয়া ধোলাই নদীর মুখ চিহ্নিত করাই মুশকিল! অথচ সুদূর অতীতে এই ধোলাই ছিল বালুর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার সংযোগ স্থাপনকারী নদী। খরস্রোতা। সেই স্রোতে ধরে রাখলে আপনাআপনি ধোয়া হয়ে যেতো মসলিন কাপড়। ওই নদীর নাম তাই ‘ধোলাই’ হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
চনপাড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে ডেমরায় শীতলক্ষ্যায় মিশেছে বালু। যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, ‘বিক্রমপুরাধিপতি কেদার রায়কে পরাজিত করে মানসিংহ শিবির পাতেন ডেমরায়। কিছুদিন থাকেন। ঈসা খাঁর সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়।’
এখানকার জামদানি পল্লী এখনও সেই গৌরবময় অতীতের সাক্ষী। এখানে হাট গমগম করে প্রতি শুক্রবার। বিকিকিনি শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। দ্বিতীয় প্রহরে দিন গড়াতে না গড়াতেই সাঙ্গ হয় জামদানির হাট।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
আরও পড়ুন-
কুকরি মুকরির বন সাগরে