ট্রাভেলগ

পণাতীর্থের যাদুকাটায়

যাদুকাটার তীরে বাঁধা নৌকার সারি (ছবি: আবু বকর)সীমান্তের ওপারে পাথরের পাহাড়। মেঘমাখা আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। গাছগাছালিতে ছাওয়া। একটা ঝরনা উঁকি দিয়েই গড়িয়ে নেমেছে নিচে। দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে গাছের আচ্ছাদনকে মনে হচ্ছে সবুজ চাদর। সেই চাদরের বুকে ঝরনাটা যেন সরু একটা সাদা ফিতা!

পাহাড়ের পাদদেশে ঝরনার পতনমুখের এপাশে কাঁটাতার। এখানকার সবুজ মাঠ মূলত পাথরের খামাল। জমিন খুঁড়ে পাথর তুলছে মানুষ। এরপর সেসব জমা করা হচ্ছে বাঁধরাস্তার পাশে।

রাস্তাটা এখানে মোচড় নিয়ে পাহাড়ের সমান্তরালে ডানে এগিয়েছে। শেষ মাথায় শাহ আরেফিনের মোকাম। সেটিকে পাহাড়ের কাছ থেকে পৃথক করে রেখেছে সীমান্ত জুড়ে রাখা কাঁটাতার। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি উল্লেখ করেছেন, শাহজালালের প্রধান অনুসঙ্গী ছিলেন শাহ আরেফিন।

প্রতি এপ্রিলে মেলা জমে এই শাহ আরেফিনের মাজারে। তখন গোটা এলাকা হয়ে ওঠে সব ধর্মের মানুষের মহামিলনমেলা।

কাঁটাতারের ওপাশে শাহ আরেফিন ঝরনা (ছবি: আবু বকর)বাঁয়ে পাহাড়ের ফাঁক গলে নেমে আসা নদীটা বৃষ্টিধোয়া পানিতে ঘোলা। সীমান্ত পেরিয়েই দু’ভাগ হয়ে এগিয়ে এসেছে। তারপর ফের পরিণত হয়েছে একটি ধারায়।

এ নদীর রূপে মুগ্ধ হয়ে মাছ কাটতে কাটতে মনের ভুলে নাকি যাদু নামে এক শিশুকে কেটে ফেলেছিলেন তার মা! সেই থেকে এই নদীর নাম ‘যাদুকাটা’। তবে কিংবদন্তির গল্পটা ভিন্ন। তাতে বলা হয়েছে, নদীটির জন্ম দেন অদ্বৈত্য প্রভু।

ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় প্রথম খণ্ডে অক্ষয় কুমার দত্ত লিখেছেন, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যের অন্যতম সহকারী ছিলেন অদ্বৈত্য। লাউড়ের নবগ্রামে তার জন্ম, ১৪৩৪ খ্রিষ্টাব্দে।
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লিখেছেন, একরাতে অদ্বৈত্য প্রভুর মা স্বপ্নে দেখেন, বিভিন্ন তীর্থের জলে স্নান করছেন। সকালে তিনি তীর্থ গমনের বিভিন্ন অসুবিধার কথা চিন্তা করে বিষণ্ন হন। মায়ের মন খারাপ হওয়ার কারণ জানতে পারে বালক অদ্বৈত্য। প্রতিজ্ঞা বা পণ করেন, সব তীর্থের আবির্ভাব ঘটাবেন মায়ের কাছে।

তারপর অদ্বৈত্য সব তীর্থকে লাউড়ের এক ছোট শৈলের ওপর নিয়ে এলেন। সেখান থেকে ঝরনা হয়ে তীর্থবারি ঝরতে থাকলো। জননী তাতে স্নান করে পরিতৃপ্ত হলেন। লাউড়ে উৎপত্তি হলো এক তীর্থের। অদ্বৈত্যের মতো তীর্থগুলোও পণ করলো, প্রতি বারুণীতেই এখানে আবির্ভূত হবে। সেই থেকে তীর্থ হয়ে উঠল জায়গাটা। নাম হলো ‘পণাতীর্থ’। পণ থেকে যেমন পণাতীর্থ নাম হলো, তেমনই পণ বা যাদু দিয়ে কাটা বলে নদীর নাম হলো ‘যাদুকাটা’।

এ নদীর আরেক নাম রক্তি। সীমান্তের ওপাশে কালাটেক নামেও ডাকা হয় নদীটাকে। বিশ্বম্ভরপুর আর তাহিরপুর পেরিয়ে জগন্নাথপুরে সুরমায় পড়ার আগে ৩২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে বারোমাসি প্রবাহের যাদুকাটা। এর উৎসমুখের পাহাড়ি খাঁজে ডিম ছাড়ে বিরল প্রজাতির মহাশোল।

বাঁধরাস্তাটা নদীর পাশে পাশেই এগিয়েছে ভাটির দিকে। পাড় সবুজ ঘাসে ছাওয়া। সামনে নানান রঙা পাথরের অতিকায় স্তূপ। যাদুকাটার বুক বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসা পাথর তুলে খামাল দিয়ে রাখা। পাশেই পাথর ভাঙার মেশিন চালু পুরোদমে। বিকট শব্দে কান ঝালাপালা। ভাঙা পাথর মাথায় তুলে নৌকা বোঝাই করছেন শ্রমিকরা। ঘাটের পাশেই লাউড়ের গড় বাজার।

বিন্নাকালী বাজারের পাশে যাদুকাটা নদী (ছবি: আবু বকর)গড় বলতে সাধারণত উঁচু ভূমি বা দুর্গ বোঝায়। আর লাউড় হলো সিলেটের প্রাচীন তিন রাজ্যের অন্যতম। গোটা সুনামগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ ও হবিগঞ্জের কিয়দংশ জুড়ে এর বিস্তৃতি ছিল। লাউড় পাহাড়ের ওপর ছিল কামরূপের রাজা ভগদত্তের রাজধানী। সেটি ছিল অতি সুরক্ষিত, দুর্গে ঘেরা।
অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লিখেছেন, পুরাকালে লাউড় পাহাড়ে ভগদত্ত রাজার রাজধানী ছিল। দৈবশক্তি সম্পন্ন দ্রুতগামী এক হাতি ছিল তার। সেই হাতির পিঠে তিনি সীমান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করতেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে লাউড় শাসন করেন রাজা বিজয়।
কিন্তু লাউড় অধিপতির বংশ বিলোপের পর এই প্রসিদ্ধ রাজ্যের পতন শুরু হয়। খাসিয়ারা অত্যাচার শুরু করে। ক্রমাগত আক্রমণের মুখে লাউড়ের মানুষ বানিয়াচংপতির সাহায্য চায়। গোবিন্দ খাঁ তখন লাউড় জয় করেন। বানিয়াচং রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কেশব মিশ্রের নাতি কর্ণ খাঁ উপাধিধারী পদ্মনাভের কনিষ্ঠ পুত্র তিনি। লাউড়ের অধিপতি তখন মোগল সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষক বলে পরিগণিত হতেন। আর গোবিন্দ খাঁ হন গোটা লাউড় রাজ্যের রাজা।
কিন্তু ফের শুরু হয় খাসিয়া আক্রমণ। আগের চেয়ে আরও প্রবলভাবে। পাহাড় থেকে পঙ্গপালের মতো নেমে আসে খাসিয়ারা। তাদের আক্রমণে গোটা জনপদ তছনছ হয়ে যায়। রাজসৈন্যদের মৃত্যু হয়। কিছু অধিবাসী দৌড়ে পালাতে সক্ষম হলেও অধিকাংশই নিহত হয় খাসিয়াদের হাতে। তাতে জনশূন্য হয়ে পড়ে লাউড়ের গড়। ধ্বংস হয় অদ্বৈত্যর জন্মভিটা নবগ্রাম।
সুনামগঞ্জের তহসিলদার রুক্ষিণী কান্ত আচার্য ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে অদ্বৈত্যের বাড়ি চিহ্নিত করেন। প্রতিষ্ঠা করেন আখড়া। লাউড়ের গড় বাজার থেকে একটু ভাটিতে এগোলেই সেই পণাতীর্থ ধাম। দেয়ালঘেরা চৌহদ্দিতে একাধিক মন্দির থাকলেও আদি কাঠামো বহু আগেই বিলীন। তবে এখানেও মেলা বসে প্রতি বারুণিতে। শাহ আরেফিনের দরগা থেকে পণাতীর্থ পর্যন্ত সমাবেশ হয় লাখো মানুষের।

যাদুকাটায় খেয়া পারাপার (ছবি: আবু বকর)এখান থেকে আরও খানিক ভাটিতে বিন্নাকালী বাজার। যাদুকাটার ঢেউয়ে ভাঙছে। ওপাড়ে গড়কাঠি, বাদারঘাট, বড়ছড়া, টেকেরহাট। মানুষ আর মোটরসাইকেল পার হচ্ছে নৌকায়। অনতি দূরে এক ঘাটে খুঁটিতে বাঁধা সারি সারি ডিঙি, গাছপালার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে বসেছে। পুরো এলাকাটাই মনকাড়া সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে আছে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক