ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝরনাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরীর সৃষ্টি। দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর ও ভবানীপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাণীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে শিবগঞ্জ বাজারের কাছে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় এটি।
একসময় সমগ্র নদী ‘সুমসাং’ নামে পরিচিত ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে, ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে গারো পাহাড়ে আসেন সোমেশ্বর পাঠক নামের এক ব্যক্তি। ওই সময় গারো পাহাড় ও আশপাশের এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা। নানান প্রজাতির পশু-পাখির কলকাকলিতে সারাক্ষণ মুখর থাকতো এখানকার পরিবেশ। এসব সৌন্দর্য ও সুমসাং নদীতীরের নীরবতা সোমেশ্বরকে মুগ্ধ করে। তার মনে বিশ্বাস জন্মে, সিদ্ধিলাভের জন্য এই স্থান উত্তম। তাই অনুচরদের নিয়ে এখানেই আস্তানা গাড়েন তিনি। এরপর স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে তাদের। সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর গ্রাম।
অনেকের ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝরনাধারা ওই এলাকার ভেতর দিয়ে বয়ে যেত। সেই ঝরনাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে তা দুর্গাপুরের কাছে নিয়ে এসেছিলেন সোমেশ্বর পাঠক। এজন্যই এই নদীর নাম হয় ‘সোমেশ্বরী’।
সোমেশ্বরী নদীতে ঘুরে বেড়ালেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে সবুজঘেরা ও লাল চীনামাটির অসংখ্য পাহাড়। এর সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করা যাবে না। খেয়া নৌকা নিয়ে নদীতে ভ্রমণ করলে দেখা যায় গভীরে ছুটে চলছে মাছ। এছাড়া নদীর তলদেশে বালির ওপর অসংখ্য ঝিনুক আর নুড়ি পাথর পড়ে থাকতে দেখবেন।
নদী পারাপারের জন্য বাঁশ ও কাঠের সাঁকো তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষের পাশাপাশি মোটসাইকেল ও অন্যান্য ছোট যানবাহন চলাচল করে।
গারো পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদী ও দুর্গাপুর অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনও পর্যটকের কাছে ভালোলাগার। সোমেশ্বরীর দু’পাড়ের আদিবাসী মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন ও শিল্প-সংস্কৃতিসহ অনুপম সৌন্দর্য সত্যি উপভোগ্য।
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি দুর্গাপুরের উদ্দেশে সরকার ও জিন্নাত পরিবহনের বাস ছাড়ে। এগুলোর ভাড়া ২৫০-৩৫০ টাকা। দুর্গাপুর বলা হলেও সাধারণত এসব বাস সুখনগরী পর্যন্ত যায়। সুখনগরী থেকে নৌকায় চড়ে একটি ছোট নদী পার হয়ে রিকশা, বাস বা মোটরসাইকেল নিয়ে দুর্গাপুর যেতে হয়। বাস ভাড়া ২০ টাকা, রিকশায় ৮০-১০০ টাকা এবং মোটরসাইকেলে ২ জন ১০০ টাকা।
ঢাকা থেকে রাত ১০টা ১৫ মিনিটে হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে শ্যামগঞ্জ স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাস বা সিএনজি ভাড়া নিয়ে বিরিশিরি বাজার যাওয়া যায়। একটু সহজে যেতে চাইলে হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে নেত্রকোনা এসে চল্লিশা বাজার থেকে মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়ায় বিভিন্ন স্পট দেখে ফিরতে পারেন।
নেত্রকোণা জেলা সদর থেকে বাস অথবা সিএনজিচালিত ট্যাক্সি অথবা ভাড়ায় মোটরসাইকেলে করে দুর্গাপুর উপজেলায় পৌঁছালেই অনন্ত যৌবনা সোমেশ্বরী নদী দেখা যায়। নেত্রকোণা জেলা সদর থেকে দুর্গাপুর উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। এজন্য লাগবে আনুমানিক দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।
দুর্গাপুরে বেশকিছু খাবার হোটেল আছে। এর মধ্যে নিরালা হোটেল বেশ প্রসিদ্ধ। এছাড়া আশেপাশে আরও বেশকিছু খাবার হোটেল পাওয়া যায়। তবে সেগুলো পরিহার করার উত্তম। বেশি খিদে পেলে ডিম-পরোটা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে পারেন। অবশ্যই দুর্গাপুর বাজার থেকে নেত্রকোনার বিখ্যাত বালিশ মিষ্টির স্বাদ নিতে ভুল করবেন না। বিরিশিরি বাজারেও মোটামুটি মানের খাবার হোটেল আছে।
ছবি: লেখক