সাগরের দিক থেকে এখন আর কোনও নৌকা আসছে না। মহেশখালীর পশ্চিমে ছুরি মাছের জন্য পাতা জাল গুটিয়ে ফিরে এসেছেন জেলেরা। সেন্টমার্টিনের পশ্চিম দিককার ইলিশ আর টেংরা ধরা নৌকাগুলোও ফিরেছে। এমনকি লাবণী পয়েন্ট থেকে যেসব নৌকা দেখা যায় সেগুলোও ফিরে এসে নোঙর ফেলেছে।
সাগরে বাতাস নেই। তাই স্রোতও স্থির। নিশ্চল পানিতে পাতা জাল ভাঁজই হচ্ছে না। কীভাবে মাছ ঢুকবে জালে! সব নৌকা তাই তীরে ফিরে ঝিমুচ্ছে। বাতাস না আসা তক আর কেউ সাগরে যাবে না। সে আজ হোক বা কাল। বাতাস ছুটলেই কেবল পাল তুলবেন মাঝিরা।
গভীর সাগরের জেলেরা এখন বিশ্রামে। তীরের জেলেরা ঝাঁকি জালের খেও ফেলছে নৌকাসারির ফাঁকে ফাঁকে। ঠেলাজাল হাতে ছোট মাছ খুঁজছে দুই কিশোরী। মাথার ওপর গাঙচিলের ঝাঁক। মওকা বুঝে ছো মারছে জলের বুকে। কোথাওবা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছে তাজা মাছের অপেক্ষায়।
পশ্চিমে একটু এগিয়ে মহেশখালী চ্যানেল মিশেছে সাগরে। বাঁয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে এগিয়ে যাওয়া সাদা বালুর সৈকতটা খা খা। এখানে-ওখানে কাকড়ার গর্ত। গর্তের পাশে পাশে আল্পনা। এই তো সেদিন একদল বার্মিজকে এখানে নামিয়ে রেখে গেছে আদম পাচারকারীদের নৌকা। মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ওদের। ক’দিন সাগরে ঘুরিয়ে রাতের আঁধারে এখানে ওদের নামিয়ে রেখে গেছে মালয়েশিয়ার উপকূল বলে!
মহেশখালী চ্যানেলের মোহনার মুখে শুরু হওয়া সৈকতের পাশে বিশাল চরা। বিস্তৃত বালুর বুকে জাল পেতে মেরামত চলছে। বালুর বুকেই বেঞ্চি পেতে চায়ের দোকান। বর্ষায় এই চর চলে যায় পানির নিচে। সাগর তখন চলে যায় শুঁটকি পল্লীর অনেক কাছে। কিন্তু এখন, পানি নেমে জেগে ওঠা চরটা সাগরের মতোই ঢেউ খেলানো। ওপাশে কাঁচা রাস্তার দু’পাশে সারিবাঁধা দোকান। রাস্তার ওপরেই খেলে বেড়াচ্ছে শিশুর দল। ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে আদর দিচ্ছে বড় শিশু। ওদের পেছনেই শুরু শুঁটকি মহাল। পচা গন্ধের পাশাপাশি শুঁটকির গন্ধও প্রকট হতে থাকলো।
রাস্তার পাশে বিশাল জায়গা জুড়ে শাহ আমানত ট্রেডার্স। কোস্ট ট্রাস্টের মেকানিক্যাল ড্রায়ারে নিরাপদ শুঁটকির আয়োজন। স্বচ্ছ সাদা পলিমারের ঘরটা দেখতে ঠিক যেন একটা গ্রিন হাউস। কোনও মাছিও গলার সাধ্য নেই। ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ছুরি মাছ শুকানো হচ্ছে ফ্যানের বাতাসে। পাশের দোতলা মাচানে খোলা আকাশের নিচে ঝুলছে সারি সারি লইট্যা। নিচে সদ্য আসা কাঁচা মাছ বাছাই চলছে। দোকানঘরে ঝুলছে বিশাল বিশাল লাক্ষ্যার শুঁটকি।
একটু দূরে ইলিশে অপরিশোধিত লবণ মাখানো হচ্ছে। কাছেই একটা ড্রামের ভেতর কীটনাশক গোলানো পানি। তাতে চুবিয়ে ছুরির শুঁটকি বাঁশে ঝোলাচ্ছে এক শ্রমিক। লেজের দিকটা ওপরে। নিচে ঝুলতে থাকা মাথা বেয়ে টপটপ করে পড়ছে তরল কীটনাশক। একসময় এই টপটপ ঝরে পড়া থামবে। কিন্তু মাছের শরীরে মিশে যাওয়া সবটা বিষ ঝরে যাবে না। রোদের তাপে শুকিয়ে স্থায়ী আসন নেবে মাছের শরীরে। আর নিচের দিকে ঝুলে থাকে বলে মাথাটাতেই জমা হবে সবচেয়ে বেশি বিষ! এই বিষের কারণেই বুঝি পচা মাছের স্তূপও মাছি শূন্য। বাঁশের ডগায় জিরোতে বসা মাছখেকো পাখিগুলোরও আগ্রহ নেই বিষাক্ত মাছে।
এত বড় শুঁটকি পল্লীতে নিরাপদ শুঁটকির মেকানিক্যাল ড্রায়ার হাতেগোনা। সবখানে সনাতন পদ্ধতির আধিক্য। তাতে আবার বিষের প্রলেপ!
কক্সবাজার শহরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ক্রমে সরু হয়েছে খালটা। শুঁটকি পল্লী ছাড়ানোর পর সেটা আরও সরু হয়ে এল। পেছনে মিলিয়ে যেতে থাকলো শুঁটকির গন্ধ। কুতুবদিয়া পাড়ার কাছে দালান ঘরের পেছনে হারিয়ে গেলো খালটা। ডানে সমিতি পাড়ার পেছনে দীর্ঘতম সৈকতও এখন দালানসারির আড়ালে। ফের সঙ্গী হলো ডায়াবেটিক পয়েন্টের কাছে। এখানে সৈকত পাড়ে ছায়াময় ঝাউবন। বাঁয়ের খালটা কখনও চোখের আড়ালে গেলো। কখনও সামনে এলো নর্দমা হয়ে। পর্যটন মোটেল শৈবালের সামনে পুরো নর্দমাই প্রকট। দু’পাড় বেঁধে পাকা ড্রেন করে নিয়েছে পৌরসভা। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পেরিয়ে স্টেডিয়ামের বাঁক পেরোতেই দু’ভাগ হলো ড্রেনটি। একভাগ নর্দমা হয়েই এগিয়ে গেলো কলাতলীর দিকে। আর একভাগ ডানে ঘুরে স্টেডিয়ামের সীমানা বরাবর খানিক এগিয়ে নেই হয়ে গেলো যেন!
এবার হাতের বাঁয়ে ডানে বিচ পার্ক। উল্টোদিকে জেলা পরিষদ মার্কেট। পিউরিটি অর্গানিক ড্রাই ফিশ শপের ঠিক সামনেই একটি টিউবওয়েল। হ্যান্ডেলে শিকল পেঁচিয়ে তালা মারা। সৈকতের বালু মাড়িয়ে কেউ এসে পা ধুয়ে নিতে চাইলে টাকা গুনতে হবে আগে। তারপর তালা খুলবে। দশ টাকায় মাত্র দু’বার টিউবওয়েল চাপে বেরিয়ে আসা জল মিলবে! পাবলিক টিউবওয়েলের কী দারুণ দখলবাজি!
শহরের কাছে হওয়ায় লাবণী সৈকতে সবসময়ই মানুষের ঢল থাকে। উৎসবে মুখরিত থাকে সাগরপাড়। দলে দলে সাগর স্নানে মাতে সবাই। কিন্তু আজ ঢেউহীন সাগরে মন বসছে না কারও। একটু থেমেই ফিরে যাচ্ছে মনমরা মানুষের মিছিল।
ডানে দীর্ঘতম সৈকতের নাজিরারটেক প্রান্ত এখনও কুয়াশায় ঢাকা। বাঁয়ে সুগন্ধা পেরিয়ে কলতলী তবু পুরোটাই দেখা যায়।
নাজিরারটেক থেকে কলাতলীর দিকে এগিয়ে আসা সেই খালটা কোথায় হারিয়েছে কে জানে! তবে পাহাড় থেকে নেমে দরিয়ানগরের পাশে একত্র হয়েছে দুটি ছড়া। মিলিত ধারা কলাতলী ছড়া নাম নিয়ে পেরিয়েছে মেরিন ড্রাইভ রোড। তারপর সৈকত মাড়িয়ে মুখ লুকিয়েছে সাগরে। ছড়াটার কবজি ডোবা জল পেরিয়ে বিচ বাইক নিয়ে ছুটছেন পর্যটকরা। এ সৈকত ধরে এগোতে থাকলে হিমছড়ি, তারপর ইনানী। ও পথে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের বেলাভূমি মাড়িয়ে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যাবে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক