১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত জেমস রেনেলের মানচিত্রে ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি স্থানের সঙ্গে আটগাঁও নামে অষ্টগ্রামের অবস্থান দেখানো হয়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ লিটারেরি মানচিত্রেও অষ্টগ্রাম লেখা হয়েছে।
এ জনপদের পূর্বে মেঘনার ওপাশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগর ও হবিগঞ্জের লাখাই, উত্তর ও পশ্চিমে ধনু নদীর পাড়ে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন ও ইটনা এবং দক্ষিণে ঘোড়াউত্রার ওপাশে বাজিতপুর। অষ্টগ্রামকে তাই হাওরের মধ্যবর্তী জনপদ বলা চলে। জলবেষ্টিত ভূখণ্ডে সবসময়ই খোলা হাওয়া খেলে বলে এখানকার বৃষ্টিটা বেশ শীতল। সেই বৃষ্টিতে স্নান সেরে নিচ্ছে ঐতিহাসিক এক মসজিদ। অনিন্দ্যসুন্দর তার রূপ। দেয়ালের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে রেখেছে ইতিহাস, জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি।
অটুট আদি কাঠামোতে সুলতানি ও মোগল আমলের নির্মাণশৈলীর মিশেল। তাই এর নির্মাণকাল নিয়ে মতভেদ আছে। কারও মতে, সুলতানি আমলের শেষদিকে এটি নির্মিত। পরবর্তী সময়ে মোগল সংস্কারের প্রলেপ পড়েছে আদি কাঠামোতে। কেউবা এটিকে পুরোপুরি মোগল আমলেরই স্থাপনা মনে করেন। সিলেট থেকে আসা বিখ্যাত দরবেশ কুতুব শাহ এই মসজিদ নির্মাণ করেন বলে জনশ্রুতি প্রচলিত। তাই এটি কুতুবশাহ মসজিদ নামে পরিচিত।
বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির চিত্রফলকের অলঙ্করণ, প্যানেলের কারুকাজ। চারটি কোণে আট কোণা মিনার বা ট্যারেট। বলয়াকারের স্ফীতরেখায় অলঙ্কৃত। পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে মোট সাতটি প্রবেশপথ। প্রতিটিতেই অর্ধ বৃত্তাকার খিলান। সেই ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দেই এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে মোগল বিদ্বেষী বারো ভূঁইয়া নেতা ঈসা খাঁর আমলে নির্মিত মসজিদে এত বেশি মোগল প্রভাব থাকার কথা নয়। এতে অতিসঙ্গত কারণেই ধারণা করা যায় যে, মসজিদটি মোগল আমলের গোড়ার দিকে নির্মিত। খুব সম্ভবত সেই অঞ্চলের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মধ্যে সুলতানি আমলের স্থাপত্যকৌশলের ধারা তখন পর্যন্ত টিকে ছিল। তাই এতে সুলতানি আমলের প্রভাব বিদ্যমান।
বৃষ্টি থামলেও মসজিদ, মাজার সারির দেয়াল ভিজে সপসপে। মাজারের বেদিও সিক্ত। গলে জমে যাওয়া মোম আরও যেন আঁট বেঁধেছে বৃষ্টি শুষে। বৃষ্টিধোয়া লাল দেয়ালে দ্যুতি ঠিকরোচ্ছে।
মসজিদের উল্টো দিকে সরু রাস্তার ওপাশে একটা দীঘি। এখান থেকে কষ্টিপাথরের একটি মূর্তি উদ্ধারের কথা উল্লেখ আছে ‘অষ্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে। দীঘি ও মসজিদের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তাটা ধরে খানিক এগোলে হাতের বাঁয়ে দেখা যায় বিশাল দীঘি। বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাখা পাড় পিচ্ছিল হয়ে আছে। ওপাড়ে বিশাল বট। তার ওপাশে হাবেলি বা হাওলি বাড়ি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মুহররম অনুষ্ঠান হয় এখানে। শিয়া নয়, এটি সুন্নিদের অনুষ্ঠান। এতে শরিক হয় হিন্দুসহসব সম্প্রদায়ের মানুষ। শরীরে শেকল পেঁচিয়ে খোলা তরবারি হাতে মাতে শোকের মাতমে। ‘হায় হাসান, হায় হাসান’ আহাজারিতে তখন ভারী হয়ে ওঠে অষ্টগ্রামের আকাশ।
সাধক আলাই মিয়া অনুষ্ঠানটির সূচনা করেন। সিলেট জয়ের পর তরফ জয়ে শাহজালাল যাকে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সেই নাসির উদ্দিন সিপাহসালারের বংশধর বলে বিবেচিত। হাবেলি বাড়ির জামাই হয়ে আসেন তিনি। হাওলি বাড়িরই একপাশে আলাই মিয়ার মাজার। এর সামনে লেখা, ‘ত্যাগের ভেতর খোদা মেলে, ভোগের ভেতর নয়।’
বাজিতপুর থেকে দীঘির পাড় ঘাটে ঘোড়াউত্রা পেরিয়ে মোটরসাইকেলে করে আসা যায় অষ্টগ্রামে। কুলিয়ার চর থেকে স্পিডবোট বা ট্রলারে চেপে মেঘনার উজান বেয়ে বাঙ্গালপাড়া ঘাটে নামতে হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগরের চাতলপাড় ঘাট থেকেও ট্রলার আসে বাঙ্গালপাড়ায়। এখান থেকে রিকশায় কুতুব মসজিদ মাত্র ১০-১৫ মিনিটের পথ।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক