বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে পাওয়া এসব স্থাপনা নবম থেকে একাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের। বৌদ্ধবিহারের পূর্ব দিকে দুটি বৌদ্ধমন্দির এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে টানা বারান্দা, ভেতর ও বাইরের দেয়ালসহ মোট ১৮টি কক্ষ রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পরিচালক আফরোজা খান মিতা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তার দাবি, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ ভারতের পশ্চিমবাংলা সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলে এমন স্থাপনা প্রথম আবিষ্কৃত হলো। তিনি আশা করেন, বিস্তৃত খনন করা সম্ভব হলে আরও স্থাপত্যিক কাঠামো পাওয়া যাবে।
দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, এসব স্থাপনার এমন কিছু অনন্য ও ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব দিকে ইতোপূর্বে আবিষ্কৃত অন্যান্য বৌদ্ধবিহারগুলোর চেয়ে পুরোপুরি আলাদা। প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যাবলির বিবেচনায় বৌদ্ধ বিহার-মন্দির কমপ্লেক্সটির ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশ ও ভারতের বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবাংলার সমসাময়িক অন্যান্য বৌদ্ধস্থাপনা থেকে আলাদা।
আফরোজা খান মিতা জানান, অধিদফতরের গবেষকরা ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশে এমন বৈশিষ্ট্যাবলি সম্পন্ন বৌদ্ধ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে কিনা তা বোঝা ও জানার চেষ্টা করছেন। ব্যতিক্রম, অনন্য ও বিরল বৌদ্ধবিহার-মন্দিরটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানববসতির বিস্তার ও পরিবর্তন এবং ইতিহাসের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় অঞ্চল কার্যালয়ের একটি দল কেশবপুর উপজেলার গৌরিঘোনা ইউনিয়নের কাশিমপুর মৌজার ডালিঝাড়া ঢিবিতে খনন শুরু করে। আফরোজা খান মিতার তত্ত্বাবধানে এই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় অঞ্চল কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান।
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দলের অন্য সদস্যরা হলেন গবেষণা সহকারী উর্মিলা হাসনাত, মার্কসম্যান মো. রিপন মিয়া, প্রাক্তন সিনিয়র ড্রাফটসম্যান মো. জাহান্দার আলী ও প্রাক্তন আলোকচিত্রী মো. আবদুস সামাদ। মহাস্থানগড় বগুড়া থেকে আসা দক্ষ খনন শ্রমিক ও স্থানীয় শ্রমিকরা এতে অংশ নিচ্ছেন। মার্চের শেষ দিন পর্যন্ত খনন চলবে।
এ কে এম সাইফুর রহমান
সহকারী পরিচালক (প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগ)
রিচার্ড এটনের জনপ্রিয় তত্ত্ব ও প্রচলিত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের ইতিহাস সুলতানি যুগের পূর্বে নয়। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় খুলনার সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আলামতগুলো এই অঞ্চলের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা আদি মধ্যযুগ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশে আদি মধ্যযুগীয় বসতির আলামতের হিসেবে এটি আরও একটি নতুন ও অনন্য সংযোজন। ইতোপূর্বে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত সব স্থাপত্য কাঠামো আদি মধ্যযুগীয় বৌদ্ধ মন্দির বা স্তূপ। এ বছর ডালিঝাড়া ঢিবিতে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে একটি বৌদ্ধ সংঘারাম বা বিহারের স্থাপত্য কাঠামো পাওয়া গেছে। এটি দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত এলাকায় আদি মধ্যযুগের বসতিরই প্রমাণ।
উর্মিলা হাসনাত
গবেষণা সহকারী
খননের ফলে অলঙ্কৃত ইট, পোড়ামাটির ফলকের ভগ্নাংশ ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির ইট ও ফলকের ভগ্নাংশগুলোতে পদ্মফুল ও বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা আঁকা। এছাড়া চুন, সুরকি, বালি দিয়ে নির্মিত স্টাকো পাওয়া যায়। এগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও জ্যামিতিক নকশা রয়েছে। এখানে একটি বিশেষ ধরনের বাটি আকৃতির মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে যা সাধারণত সপ্তম-একাদশ শতকের বৌদ্ধবিহারসহ অন্যান্য প্রত্নস্থানে পাওয়া যায়।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
স্থাপনাটির পূর্ব দিকের অংশ ঢিবি আকারে ছিল। তবে খননের ফলে উন্মোচিত স্থাপনার বিস্তার উত্তর ও পশ্চিমের বর্তমান কৃষিজমির মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। এখনও নতুন নতুন দেয়ালের অংশ ও ফিচার উন্মোচিত হচ্ছে।
আবিষ্কৃত স্থাপনাকে প্রাথমিক পর্যালোচনায় তিনটি মন্দির বিশিষ্ট একটি বৌদ্ধবিহার বলে শনাক্ত করতে চাই। প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ সহজ না হওয়ার কারণ হলো, বিহারটির স্থাপত্যিক পরিকল্পনায় অন্যান্য বিহারের চেয়ে ভিন্নতা রয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে বর্তমান বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবাংলায় আর বাংলাদেশে অদ্যাবধি যেসব বৌদ্ধবিহার বা মহাবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে এই ভূমিপরিকল্পনার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
সাধারণত বৌদ্ধবিহারগুলো চতুষ্কোণাকার হয় (আয়তাকার বা বর্গাকার)। চারদিকে চারটি বাহুতে ভিক্ষুকক্ষ, ছোট মন্দির/চৈত্য থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে একদিকের বাহুতে মন্দির থাকে এক বা একাধিক। কক্ষগুলোর সামনের দিকে লম্বালম্বি বারান্দা থাকে। মাঝখানে বিহারাঙ্গন বা কোর্টইয়ার্ড থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বিহারাঙ্গনে একটি বা একাধিক মন্দির, নিবেদন স্তূপসহ নানান স্থাপনা থাকে (ঠিক যেমন রয়েছে পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে, কিংবা কুমিল্লার শালবন বিহারে)। কুমিল্লার রূপবান মুড়া বা ইটাখোলা মুড়া, ভোজবিহারের ভূমি পরিকল্পনায় যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনই সাদৃশ্য আছে। দিনাজপুরের সীতাকোট বিহার, অরুণ ধাপের বিহার বা দোমাইলের বিহার তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের। বগুড়ার মহাস্থানের ভাসুবিহারের আকারও একই। বিহারের নালন্দা মহাবিহারে ছোট ছোট বিহারের একটি গুচ্ছ রয়েছে।
ড. অরুণ নাগ
সাবেক অধ্যাপক (প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ; বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়)
বাংলাদেশের খুলনা আঞ্চলিক প্রত্নঅধিকর্তা দফতর থেকে ডালিঝাড়া ঢিবিতে যে খননকাজ চালানো হয়েছে তার আলোকচিত্র, ভূমি-নকশা ইত্যাদি দেখে আমার দৃঢ় ধারণা এটি একটি বৌদ্ধবিহার, যার আনুমানিক সময়কাল নবম-দশম শতক। দুটি কারণে এই আবিষ্কার অতীব গুরুত্বপূর্ণ, দক্ষিণবঙ্গে ভরত ভায়নার পর এটি দ্বিতীয় বৌদ্ধবিহার যা আবিষ্কৃত হলো এবং এই স্থাপত্যের কয়েকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কোথাও দেখা যায়নি। আমি মনে করি, সমগ্র স্থাপত্যটি প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের প্রত্নইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটবে।
ছবি: সাংবাদিক মাসুদ আলম