প্রথমে ঢুকলাম কালীচরণ লজে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির শেষের দিকে এটি নির্মিত। অন্য ভবন থেকে অনেকটা আলাদা। বর্তমানে এই লজ পুলিশের জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এখানে আছে পুলিশের ব্যবহহৃত পুরনো দিনের হাতিয়ার। বিভিন্ন ছবিতে লেখা জমিদার বাড়ির ইতিহাস। জমিদারদের ব্যবহার করা নানান সামগ্রী রয়েছে এখানে। জমিদার বাড়িতে প্রবেশের একটা আলাদা শিহরণ থাকে। কারণ এগুলোর একেকটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস।
পাশের চৌধুরী লজ গোলাপি রঙা। সুন্দর নকশাখচিত ভবনটির পিলারগুলো রোমান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। ভেতরে ঢেউ খেলানো ছাদ। দোতলা ভবনটির সামনে সুন্দর বাগান ও সবুজ মাঠ।
সবশেষে থাকা মহারাজ লজ বাইজেনটাইন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এর সামনে ছয়টি কলাম। এছাড়া ভবনের শোভা বাড়িয়েছে সিঁড়ির বাঁকানো রেলিং ও ঝুলন্ত বারান্দা। এতে মোট কক্ষ আছে বারোটি। সামনে বাগান ও পেছনে একটি টেনিস কোর্ট। এসব ভবন শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।
ইতিহাস বলছে, ১৮৯০ সালের আগে স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে প্রতিষ্ঠিত হয় মহেড়া জমিদার বাড়ি। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনী এতে হামলার পাশাপাশি বাড়ির কূলবধূসহ গ্রামের পাঁচজনকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে তারা লৌহজং নদীর নৌপথে দেশত্যাগ করেন।
আমাদের এবারের যাত্রা টাঙ্গাইলের করটিয়া জমিদার বাড়ির দিকে। কিন্তু ঢোকার পথেই বাধা। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে এখানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই ঢোকা যায়। পুরো জায়গার দৈর্ঘ্য প্রায় ১ কিলোমিটার। চারপাশ প্রাচীরঘেরা। এখানে মেলে প্রাকৃতিক ও নিরিবিলি পরিবেশ।
ভারত থেকে আসা পন্নী বংশের লোকজনই এখানে বংশ পরস্পরায় জমিদারি করে গেছেন। নিজেদের মধ্যে মামলা-মোকাদ্দমায় জড়ালেও এই অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে তাদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। তারাই প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা। মোগল ও চৈনিক স্থাপত্যের মিশেলে গড়া জমিদার বাড়িটি এককথায় মনকাড়া। রোকেয়া মহল এখন বিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
পন্নী বংশের ১১তম পুরুষ ছিলেন সা'দত আলী খান পন্নী। তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়ায় এসে পন্নী বংশের ভিত প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে সাদত আলী খান পন্নী সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে মামলায় জড়িয়ে পড়েন। ঢাকার জমিদার খাজা আলীমুল্লাহর সহায়তায় তিনি পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করেন। কিন্তু শর্তভঙ্গের কারণে পাল্টা মামলা করে খাজা আলিমুল্লাহ ভোগ-স্বত্বের ডিক্রি পান। তখন সা'দত আলী খান সম্পত্তি রক্ষার জন্য স্ত্রী জমরুদুন্নেসা খানমের নামে তা দানপত্র করে দেন। পরে অবশ্য উভয় পক্ষের মধ্যে আপস-মীমাংসা হয়।
পন্নী পরিবারের ১৩তম পুরুষ দানবীর জমিদার ‘আটিয়ার চাঁদ’ হিসেবে খ্যাত ওয়াজেদ আলী খান পন্নী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে ১৯২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর কারারুদ্ধ হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অনমনীয় মনোভাব ও দৃঢ়ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আজও লন্ডন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর তৈলচিত্রের নিচে লেখা রয়েছে 'ওয়ান হু ডিফাইড দি ব্রিটিশ।'
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে পন্নী পরিবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ পরিচিত মুখ। ওয়াজেদ আলী খানের দৌহিত্র খুররম খান পন্নী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের চিফ হুইপ ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অপর দৌহিত্র হুমায়ন খান পন্নী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। খুররম খান পন্নীর পুত্র ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (দ্বিতীয়) বাংলাদেশ সরকারের উপমন্ত্রী ছিলেন।
ছবি: লেখক