কিশোরগঞ্জের নয়নাভিরাম হাওরে দিগন্তজোড়া সড়ক

কিশোরগঞ্জের হাওরকিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল যেন কূলহীন সাগর। দ্বীপের মতো ভেসে আছে চারপাশের গ্রাম। বিশাল জলরাশির মাঝ দিয়ে দিগন্তজোড়া সড়ক মেলে ধরেছে শিল্পীর তুলিতে আঁকা চিত্রকর্ম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে রয়েছে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। 

ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ কিশোরগঞ্জ জেলার কীর্তিমানদের তালিকায় আছেন উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, গুরুদয়াল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কৈবর্তরাজ গুরুদয়াল সরকার, আনন্দ মোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দ মোহন বসু ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো দেশবরেণ্য অনেক গুণীজন। তাদের কেউ কেউ জন্মেছেন হাওর পাড়েই।

ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব‌্যয়ে নির্মাণ করা হয় ‘অল ওয়েদার রোড’। এর মা‌ধ‌্যমে ৪৭ কিলোমিটার উঁচু পাকা সড়ক ও ৩৫ কিলোমিটার সাবমার্সেবল সড়ক এবং দৃষ্টিনন্দন সেতু ধরে সারাবছর যাতায়াত করে মানুষ। অল ওয়েদার সড়কের দু’পাশে থই থই পানি। বর্ষায় আকাশে সাদা মেঘের ভেলা মন কাড়ে। মেঘ আর জলের মিতালী এককথায় মনোরম। হাওরের এমন সৌন্দর্য আকৃষ্ট করছে পর্যটকদের।

কিশোরগঞ্জের হাওরপ্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখে পড়ে হাওরের অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি। এগুলো দেখে সুইডেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা অন্য কোনও দেশের মনে হলেও আদতে তা কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল। এসব ছবি দেখে করোনাভাইরাস মহামারিতেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে বেড়াতে আসছেন।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ঘুরতে আসা সাব্বির হোসাইন ফুয়াদ বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘ফেসবুকে হাওরের বিভিন্ন ছবি দেখে বেড়ানোর জন্য মন ব্যাকুল ছিল। এখানে এসে মনে হচ্ছে, দেশের বাইরে কোথাও ভ্রমণে বেরিয়েছি বুঝি! হাওরের বুক চিরে থাকা এই রাস্তাগুলো আরও বেশি করে হাওরপ্রেমী করে তুলেছে মনটা।’

কিশোরগঞ্জের হাওরমো. ফখরুল আলম সুনামগঞ্জ থেকে ট্রলার দিয়ে ঘুরতে এসেছেন কিশোরগঞ্জের হাওরে। তার কথায়, ‘আমি হাওরাঞ্চলের মানুষ। কিন্তু যে হাওরে বেড়ে উঠেছি তার সঙ্গে এখানকার সৌন্দর্যের ফারাক দিন-রাতের মতো। ট্রলার দিয়ে এসে এখন পিচ ঢালা পথে হেঁটে হাওর ঘুরছি। এ অভিজ্ঞতা অভূতপূর্ব। কিশোরগঞ্জের হাওরে এলে সব প্রকৃতিপ্রেমীরই দারুণ ভালো লাগবে।’
সাগরে যেভাবে সূর্য ডোবে, হাওরেও তেমনই। ভোরে পানির নিচ থেকে উঠে আসা সূর্যকে দেখলে অন্যরকম অনুভূতি জাগে মনে। হাওরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সৃষ্টি হয় চমৎকার সৌন্দর্য। সূর্যোদয়ের সময় আকাশের বুক থেকে অগ্নি রশ্মি পড়ে বহমান জলে। সূর্যাস্তের সময় লালচে আকাশে ফুটে ওঠে ভিন্ন রূপ। রাতে হাওরে ঢেউ ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো। ছবির মতো ভেসে বেড়ায় মাছ ধরার নৌকা। যারা এমন বৈচিত্র্যময় জনপদ দেখেননি, তাদের কাছে হাওর এক বিস্ময়। 

কিশোরগঞ্জের হাওরইটনা উপজেলার শিমুলবাগে জনমানবহীন ভাসমান বনভূমির নাম রাংচাবন। সারি সারি হিজল-তমাল-করচ গাছ যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের ‘দিল্লির আখড়া’ ভালো লাগার মতো। এখানে রয়েছে শত শত হিজল গাছ। ৪০০ বছরের পুরনো এই আখড়া সম্পর্কে জানতে পর্যটকরা রীতিমতো ভিড় করেন। এছাড়া অষ্টগ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের পুরনো পাঁচ গম্বুজের কুতুব শাহ মসজিদ, আওরঙ্গজেব মসজিদ, ঈশা খাঁ’র সময়ে নির্মিত ইটনার শাহী মসজিদ, মোগল আমলে নির্মিত নিকলীর গুরুই মসজিদ পর্যটকদের মন কাড়ে।

পর্যটকদের সুবিধার্থে উপজেলা তিনটিতে গড়ে উঠেছে বেশকিছু হোটেল ও রেস্তোরাঁ। এগুলোতে রাতযাপনের পাশাপাশি হাওরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের স্বাদ নিতে পারেন।

কিশোরগঞ্জের হাওরতবে দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাওরপ্রেমীদের কেউ কেউ ছোট-বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। গত ১৫ দিনে মোটরসাইকেল নিয়ে হাওর দেখতে এসে অসচেতনতার কারণে মৃত‌্যুর মুখে পড়তে হয়েছে অনেককে। দুর্ঘটনা এড়াতে নৌ-পথে মোটরসাইকেলের চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন।

মিঠামইন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রভাংশু সোম মহান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নৌ-পথে মোটরসাইকেল চলাচলের কারণে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনা হচ্ছে। তাই মোটরসাইকেল নিয়ে হাওরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে পর্যটকদের জন‌্য হাওর উন্মুক্ত। কারও আসতে কোনও বাধা নেই।

হাওরের সৌন্দর্য‌ ও পর্যটনের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ইউএনও বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবেই হাওরের সৌন্দর্য‌ নয়নাভিরাম। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সারাবছর চলাচল উপযোগী অল ওয়েদার রোড। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে কিশোরগঞ্জের এই হাওর হয়ে উঠতে পারে দেশের সেরা পর্যটন গন্তব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।’