ছাইয়ের নিচে চাপা ছিল ২ হাজার বছর আগের আধুনিক শহর

বইয়ের পাতায় প্রাচীন রোমান নগরী গল্প পড়লে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু রোমান কোনও স্থাপত্যের সামনে আপনি যদি দাঁড়ান, তখন অবিশ্বাস্য গল্পকে বিশ্বাস করতে হবে। ২ হাজার বছর আগেও কী করে সম্ভব হয়েছিলে এত বড় নান্দনিক স্থাপনা করার! এগুলোর নকশা যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি বিস্ময় জাগবে- কী করে এত বড় স্থাপনা নির্মাণ করা হলো; যা টিকে আছে যুগের পর যুগ।

ইতালির রোম থেকে বাসযোগে নেপলস, আর সেখান থেকে পম্পেই বেশি দূর নয়। নেপলস শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিলেই পম্পেই। গাড়িতে যেতে সময় লাগবে ২৫ মিনিট, ট্রেনে গেলে ৩৫ মিনিটি।



আধুনিক যুগে এসেও অনেক দেশে অনেক জায়গায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই, সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থাও অপ্রতুল, রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং শহর ছাড়া অন্য জায়গার রাস্তায় দেখা মিলবে না। কিন্তু ২ হাজার বছর আগের পম্পেইয়ে এসব বিদ্যমান ছিল। শুধু তাই নয়, এখনকার আধুনিক শহর বলতে যা বোঝায়, সবই ছিল প্রাচীন এই নগরীতে; তার সাক্ষী রয়ে গেছে এখনও।

ইতালিতে পর্যটকদের অন্যতম আর্কষণ পম্পেই নগরী, সেখানে সবসময়ই পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। নেপলস থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই নগরী ছিল সৈকতের কাছাকাছি। তবে ভয়াবহ ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরিও ছিল এই নগরের অতি নিকটে। ইতিহাস বলে, এই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কারণেই পম্পেই শহর পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। এভাবে একটি নগরী ধ্বংস হবে তা দুঃস্বপ্নেও হয়তো ভাবতে পারেননি কেউ।



পম্পেই নগরী এখন শুধুই একটি দর্শনীয় স্থান। সেখানে প্রবেশ করলে স্থানীয় গাইডরা এই নগরীর বিভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরে স্থাপনাগুলো দেখান। ইতিহাসের পাতা থেকে তারাই জানালেন, সেসময় ২ দিনের অগ্ন্যুৎপাত হয় ভিসুভিয়াস পাহাড় থেকে। তবে আগুনে পুড়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে তেমনটা জানা যায় না। বলা হয়, প্রবল ধোঁয়া আর ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের কারণেই বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হয়। পুরো নগরী ছাইয়ে নিচে ঢাকা পড়ে যায়। বাঁচার সুযোগও পায়নি এই শহরের বাসিন্দারা।

ছাইয়ের নিচে চাপা পড়া শহরকে খনন করে সেই সময়ের স্থাপনা পাওয়া যায়। সেই সময়ে কাঠের দরজা, জানালাগুলো নেই, তবে অন্যান্য অনেক কিছু এখন অবিকল রয়ে গেছে।



পম্পেই, এ বিধ্বস্ত নগরীকে দেখতে  প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন। ২ হাজার বছর আগে অগ্নিগিরির ছাইয়ে চাপা পড়ে একটি শহর, খনন করার পরও স্থাপনাগুলো এখন টিকে আছে। নকশা, কাঠামোর স্থিতিশীলতা প্রমাণ করে কতটা দৃঢ় ছিল নির্মাণ শৈলী।

বিনোদন জন্য এই নগরীতে ছিল দুটো থিয়েটার। গাইড জানালেন, এখানে গান ও অভিনয় আয়োজন হতো। একটি থিয়েটারে প্রায় ৫ হাজার দর্শকের একসঙ্গে বসতে পারতেন। ২ হাজার বছর আগে এক সঙ্গে ৫ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতার থিয়েটার! বাংলাদেশে এখন ৫ হাজার মানুষ একসঙ্গে বসার জায়গা কয়টা আছে, সেই ভাবনা হয়তো অবচেতনেই মনে চলে আসবে।



পম্পেই নগরী হেঁটে হেঁটে যতই ভেতরে প্রবেশ করবেন, ততই বিস্ময়ে জাগবে। মানুষের স্বাভাবিক নাগরিক চাহিদা মাথায় রেখে ২ হাজার বছর আগে একটি নগরী গড়ে উঠেছে। এখনও আধুনিক নগরীর পরিকল্পনায় যা ভাবা হয় না, কিংবা দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে হয়। আর ২ হাজার বছর আগে তা দেখেছে পম্পেই নগরীর বাসিন্দারা। মানুষের সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে ছিল বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, শুধু তাই নয় সেই পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থাও ছিল। আবার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ছিল।

সেই সময়ে নগর পরিকল্পনা মুগ্ধ করবে যে কাউকে। গাইড জানালেন, এই নগরীতে ছিল খাবারের দোকান, যেখানে নানান রকমের রুটি ও খাবার বিক্রি হতো। একই সঙ্গে পাওয়া যেতো ওয়াইনও। ভিসুভিয়াসের অঞ্চলের আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইন বিখ্যাত ছিল সেই সময়ে। অনেক দূর থেকে এখানে অনেকে আসতেন ওয়াইন কিনতে।



পম্পেই নগরীর প্রতিটি স্থাপনার রয়েছে আলাদা রকমের গল্প। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন স্থাপনা বিশ্লেষণ করে সেই সময়ের ইতিহাসকে তুলে ধরছেন নতুন মাত্রায়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকাজ হচ্ছে এই শহরকে কেন্দ্র করে।

ছাই চাপা পোম্পেই নগরী পুনরাবিষ্কার হয় ১৫৯৯ সালের দিকে। একদল প্রকৌশলী সারনো নদীর খনন কাজ করতে গিয়ে প্রাচীনযুগের কিছু দেওয়ালের সন্ধান পান। ১৭৪৮ সালে নেপলসের রাজা চার্লস বারবুন নির্দেশে প্রত্নতত্ত্ব, মূর্তি রাজ দরবারে উপস্থাপন করার জন্য তৎপরতা ‍শুরু হয়। ছাইয়ের নিচ থেকে পম্পেই-কে উদ্ধার করা হয় ধীরে ধীরে।



পম্পেই নগরীতে দেখা যায় ‘ফোরাম বাথ’, অর্থাৎ সর্বসাধরণের জন্য গোসলখানা। যেখানে ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যবস্থাও ছিল। এই নগরীতে ছিল পতিতালয়ও। ২৫টি পতিতালয় চিহ্নিত করতে পেরেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা। গাইড জানালেন, রোমান আর গ্রিক বণিকরা এখানে আসতেন বিনোদনের জন্য। পম্পেই নগরীর যৌনজীবন ছিল নির্মম ও বিকৃত। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারীদের এখানে আনা হতো।

বাংলাদেশ থেকে যে কেউ ঘুরে আসতে পারেন পম্পেই নগরীতে। ইতালির রোমে যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট। প্রতি সোমবার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে ফ্লাইট ছেড়ে যায় রোমের উদ্দেশে।

ছবি: প্রতিবেদক