কিন্তু সারারাত বাস জার্নি, তার ওপর চট্টগ্রামের পর থেকেই পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথের ঝাঁকি, শরীর বলে তো একটা বিষয় আছে! নাহ, কারও এ নিয়ে ভাবনা নেই। অগত্যা আমিও ওদের দলে ভিড়ে গেলাম। তখনই চোখের সামনে এক নতুন আলো জ্বলে উঠলো। কী বিস্ময়কর সুন্দর! কুয়াশাঘেরা পাহাড়ের ওপার থেকে একটু একটু করে জেগে ওঠা সেদিনের সূর্য যে না দেখেছে, তাকে কোনোভাবেই বোঝানো যাবে না। কাপ্তাই লেকের পানিতে দিনের আলোর রঙ অদ্ভুত মায়া নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমরা সবাই অভিভূত হয়ে তাকিয়ে আছি।
রাঙামাটিকে রাঙিয়ে সূর্যের জেগে ওঠার এই দৃশ্য হোটেল নাদিশার ছাদ থেকে দেখছিলাম। রিজার্ভ বাজারে যেখানে ঢাকার বাস এসে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়, সেখানেই হোটেলটি। রাঙামাটির ছেলে সাগর ওয়াহিদ আগে থেকেই আমাদের জন্য বুকিং দিয়ে রেখেছিল। আলো ফোটার আগেই পৌঁছে গেছি। বাস থেকে নামতেই সাগরের হাসিমুখ। এই ভোরে তাকে অপেক্ষায় দেখে প্রথমে একটু অবাক হলাম। পরে অবশ্য জেনেছি, এখানকার মানুষ ভোর হওয়ার আগেই জেগে ওঠে, বেরিয়ে পড়ে।
খুব সাদামাটা শহর। মফস্বল হলে যা হয় আর কি! উঁচু উঁচু দালান নেই, সড়কে যানজট চোখে পড়লো, অযাচিত কোলাহলও কান ঝালাপালা করে না। শহরটার চারপাশে কেবল জলের মাঠ। কাপ্তাই লেকে ঘেরা পুরো শহরের যেদিকেই চোখ যাবে, সেদিকেই জলের দেখা মিলবে। দৃষ্টিকে একটু দূরে পাঠালেই আটকে যাবে পাহাড়ের সৌন্দর্যে। মানুষগুলোও শান্ত, সুন্দর। পাহাড়ি পথ বলে এখানে ঢাকার মতো রিকশা চলে না। পুরো শহরে একটা রিকশারও দেখা পাইনি। তবে টেম্পু, ট্যাক্সি আছে অনেক। যেকোনও জায়গায় যখন তখন যেতে ট্যাক্সি পাওয়া যায়।
ওপারের পাহাড় পেরিয়ে আদিবাসী গ্রাম। পর্যটকদের জন্য বাজারও বসে প্রতিদিন। সেখানে পাহাড়ি ফল থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। বিশেষ করে পাকা কলা, পেঁপে, আনারস ও ডাব দেখে মনে হবে কোনটা রেখে কোনটা খাই! পাহাড়টাতে খুব একটা পাহাড়ি আমেজ নেই। কোলাহলে মুখর চারপাশ। তবে পাহাড়ের পাদদেশে নামলেই জল এসে পা ছুঁয়ে যাবে। সেখানে রঙিন নৌকায় চড়তে ইচ্ছে হবে তখনই। সুন্দর, ছোট্ট নৌকায় চড়ে হেলেদুলে আশপাশ ঘুরে দেখা আনন্দের। তবে আমরা এ বেলায় নৌকা চড়ার ইচ্ছেটাকে ভাসতে দিলাম না। কারণ পরদিন সারাবেলা জলে কাটবে আমাদের। বরকল ও শুভলংয়ে আমাদের যাত্রা হবে নৌকাতেই।
রাঙামাটির বিকাল কেটেছে জেলা পরিষদ পার্ক ও পুলিশের তৈরি পলওয়েল পার্কে। প্রকৃতির সঙ্গে কৃত্রিম নানান জিনিস রয়েছে পার্কে। তবে বিকাল কাটানোর জন্য ভালো জায়গা। পলওয়ে পার্কের ব্যবস্থাপনা দারূণ। অনেক বড় বড় জেলায়ও এমন সুন্দর পার্ক চোখে পড়েনি। কাপ্তাই লেকের সুবাদে হয়তো পার্কটিকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। পার্কের পাশে লেকের পাড় ঠিক সমুদ্র সৈকতের মতো। চৌকিও পাতা আছে কিছু। সকালে হোটেলের ছাদ থেকে যে সূর্যটাকে উঠতে দেখেছি, বিকালে এখানে শুয়ে তাকে বিদায় জানানোর অনুভূতি ছিল দারুণ!
ছবি: মুজতাহিদ হাসান, আলী মুসা চৌধুরী ও লেখক