নীলসাগরে ভ্রমণপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড়

নীলসাগর দীঘির মূল ফটকনীলফামারীর অতি প্রাচীনতম দর্শনীয় স্থান নীলসাগরে এখন ভ্রমণপিপাসুদের উপচেপড়া ভিড়। ঈদের আনন্দে চিত্তবিনোদনের জন্য এখানে বেড়াতে আসছেন নীলফামারী ও আশপাশের জেলার সব বয়সী মানুষ।

ঈদের ছুটিতে নীলফামারীর পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুর, পঞ্চগড়, তেতুলিয়া ও রংপুর থেকে ভ্রমণপিপাসুরা রেলপথ ও সড়কপথে বেড়াতে আসেন নীলসাগরে। অনেকে এখানে মৎস্য শিকার করেন। এজন্য কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় দেড় হাজার টাকা।

নীলফামারী শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে জেলা সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোপাডাঙা মৌজায় ৫৩ দশমিক ৯০ একর জমির ওপর অবস্থিত নীলসাগর। এর পানির গভীরতা প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ ফুট।

জেলা প্রশাসনের পক্ষে এসএ শাখার কর্মকর্তা দীনবন্ধ রায় বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নীলসাগর জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র। এখানে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা। এছাড়া বাইসাইকেল ১০ টাকা, মোটরসাইকেল ৫০ টাকা, কার ও মাইক্রোবাস সারাদিনের জন্য ১০০ টাকা, বাস-মিনিবাস ঢোকার জন্য গুনতে হয় ২০০ টাকা।

নীলসাগরের চারদিকে রয়েছে নারিকেল, আকাশমনি, লতাগুল্ম, দেবদারুসহ অজানা-অচেনা হরেকরকম ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি। পড়ন্ত বিকালে সূর্যের লাল আভায় দর্শনার্থীদের মন হারিয়ে যায় গুল্মলতায় বেষ্ঠিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই দীঘির জলে। একটি ছোট পার্কে রয়েছে শিশুদের জন্য চড়কি, দোলনা, ঘোড়ার গাড়ি, সাঁতারের নৌকা, পশু-পাখির ছবি।

এখানকার রেস্ট হাউজের এক নম্বর কক্ষ দেড় হাজার টাকা, দুই নম্বর কক্ষ ১ হাজার ২০০ টাকা ও তিন নম্বর কক্ষ ১ হাজার টাকা। এছাড়া আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দুটি আবাসিক হোটেল। এছাড়া সুলভ মূল্যে মিলবে দেশীয় খাবার। এর মধ্যে আছে শুঁটকি মাছের ভর্তা, পেল্কা, সিদোল, পুকুরের মাছ, ছোট মাছের চড়চড়িসহ নানান খাবার।

নীলসাগর

প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারুনী স্নান ও মেলায় মুখর হয়ে ওঠে নীলসাগর। এই আয়োজনে হস্তশিল্প, কারুশিল্প, বাঁশ ও কাঠের আসবাবপত্র, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশের বাঁশি, শিশুদের খেলনাসহ হরেক রকমের পণ্য পাওয়া যায়। এছাড়া মেলায় থাকে পুতুলনাচ, যাত্রা গান, পালা গান। গুড়ের জিলাপির জন্য নীলসাগরের মেলা প্রসিদ্ধ।

জানা যায়, একসময় রেওয়াজ ছিল— গাভীর প্রথম দুধ এই দীঘির পানিতে দিলে গাভীর কাছ থেকে বেশি পরিমাণ দুধ পাওয়া যেত। রেওয়াজ অনুযায়ী মালিকরা প্রথম গাভীর দুধ দীঘিতে ঢেলে না দিলে কাউকে খেতে দিতেন না। কারণ দুধ বেশি পাওয়ার আশায় তারা দূরদূরান্ত থেকে এখানে আসতেন। সেই বিশ্বাস থেকে এখনও এখনও গ্রামের মানুষ গাভীর প্রথম দুধ নীলসাগরের পানিতে ঢেলে দেয়। এছাড়া বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দীঘির পাড়ে পূজা-পার্বণ করে।

উত্তর-দক্ষিণে লম্বা নীলসাগর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে বহু উপাখ্যান ও রূপকথা। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে জলাশয়টির খনন শুরু হয়েছিল। কথিত আছে, তৎকালীন বিরাট রাজা বসবাস করতেন এখানে। তার বিপুলসংখ্যক গবাদি পশু ছিল। এগুলোকে গোসল ও পানি খাওয়ানোর জন্য একটি দীঘি খনন করান তিনি। রাজার নামানুসারের এর নামকরণ হয় ‘বিরাট দীঘি’। কালের বিবর্তনে রাজার একমাত্র মেয়ে বিন্নাবতীর নামানুসারে এটি ‘বিন্না দীঘি’ নাম ধারণ করে। ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সচিব এমএ জব্বার এই দীঘিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত করতে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালে নীলফামারী জেলার নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ‘নীলসাগর’। তখনই এই এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়।

নীলসাগর ছাড়াও তিস্তা ব্যারাজ, পাল রাজার বাড়ি, নীলকুঠির, কুন্দুপকুর মাজার, চিনি মসজিদ, ব্রিটিশ আমলের মন্দির, ভিমের মায়ের চুলা, হরিশ্চন্দ্র রাজার বাড়ি, ধর্মপালের গড় সাম্প্রতিক কালে নির্মিত ওসমানী উদ্যান ও দিনাজপুর ক্যানেল দেখতে ভিড় জমে ভ্রমণপ্রেমীদের।