খাগড়াছড়ি জেলা ও পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত একদশকে নতুনভাবে ২০-২৫টিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক পর্যটন স্পট যুক্ত হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন মনোরম স্থানকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পর্যটন স্পট। এসব স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ১৭০টি সরকারি-বেসরকারি হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও অতিথিশালা। এছাড়া চালু হয়েছে দুই-তিনশ’ ছোট-বড় রেস্তোরাঁ।
পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে ব্যক্তিগত ও সমিতিভিত্তিক ট্যুরিস্ট বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, কার, সিএনজি, চাঁদের গাড়ি, মোটরসাইকেল। জেলার নয়টি উপজেলায় পর্যটকদের সেবা দিতে দুই শতাধিক গাড়ি প্রস্তুত থাকে।
খাগড়াছড়ি পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলমের মন্তব্য, ‘পর্যটনকে কেন্দ্র করে ছোট-বড় প্রচুর গাড়ি নামানো হয়েছে। ফলে পরিবহন খাতে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পর্যটন স্পট বাড়ানো সম্ভব হলে আরও বেশি লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে সবসময় উন্নত সেবা থাকা চাই।’
খাগড়াছড়ি মিনি সুপার মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পর্যটকদের সুবাদে খাগড়াছড়িতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। তারা স্থানীয়ভাবে তৈরি কাপড় কেনেন। মেয়েদের মধ্যে পাহাড়ি নারীদের বানানো থামী, পিনন, ব্লাউজ, কাঠের তৈরি বিভিন্ন শো-পিসের ব্যাপক চাহিদা।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়িতে এমনিতেই সবুজাভ পাহাড়ের ছড়াছড়ি। সেই সঙ্গে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী, মাইনি ও ফেনী নদী খাগড়াছড়িকে সাজিয়েছে অপরূপ সাজে। চারদিকে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজ পাহাড়, ঝরনা, প্রাকৃতিক লেক, কৃত্রিম লেক এবং ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবন-সংস্কৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য খাগড়াছড়ি অত্যন্ত চমৎকার জায়গা। অনেকে নয়নাভিরাম সবুজাভ পাহাড়ের দৃশ্য, চপলা ঝরনা, সর্পিল নদী, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি উপভোগ করতে আসেন। এর সুবাদে স্থানীয় লোকজনের আয়ের প্রধান খাত এখন পর্যটন। বলা যায়, একলাখ লোক পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে পরিবার চালাচ্ছে।’
বেসরকারি হোটেল গাইরিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, খাগড়াছড়িতে প্রচুর পর্যটক আসে। বেশিরভাগ হোটেল সবসময় বুকিং থাকে। পর্যটকদের জন্য তাদের হোটেলে স্থানীয় বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার রাখা হয়। এছাড়া কেউ চাইলে নির্ধারিত ফি দিয়ে স্থানীয় শিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান উপভোগ করতে পারেন।
অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার মতে, ‘পর্যটকদের থাকা ও ব্যবহারের জন্য অবকাঠামোগুলো অত্যাধুনিক মানের করার পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্কসহ সব ধরনের ডিজিটাল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ভ্রমণপিপাসুদের রাতে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার মতো জায়গা আরও দরকার। পাশাপাশি দিনের বেলা কাছাকাছি জেলায় যাতায়াতের জন্য আধুনিক ট্যুরিস্ট বাস সেবা লাগবে।’
খাগড়াছড়িতে গড়ে ২০-৩০ হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক আসছে বলে জানান হোটেল অরণ্য বিলাসের মালিক স্বপন চন্দ্র দেবনাথ। তাদের সুবাদে জেলায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দরিদ্র, বেকার ও কর্মহীন মানুষগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে জেলার বাসিন্দাদের জীবনমান ইতিবাচকভাবে বদলেছে। পর্যটনের মাধ্যমে কম করে হলেও একলাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান পেয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবার চালানোর পাশাপাশি তারা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।’
বেসরকারি রেস্তোরাঁ স্বপ্নচূড়ার মালিক ও নারী উদ্যোক্তা নেইম্রা মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার হোটেলে এখন গড়ে দুই-তিনশ’ স্থানীয় ও বাইরের অতিথি আসে। ফলে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পর্যটন শিল্পের বিকাশে শত শত খাবারের হোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে এবং হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পর্যটন শিল্পের যেমন বিকাশ হবে, তেমনই স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।’
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আহমারউজ্জামান জানান, বর্তমানে জেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো। প্রচুর পর্যটক খাগড়াছড়ির প্রতিটি পর্যটন স্পটে প্রতিদিন আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় পর্যটন পুলিশসহ ডিবি ও সাদা পোশাকে পুলিশ নজর রাখছে। কেউ চাইলে তাকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য শর্তসাপেক্ষে পর্যটন পুলিশ দেওয়া হবে।’