খাগড়াছড়িতে পর্যটনকে ঘিরে কর্মসংস্থানের নতুন সম্ভাবনা

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্কখাগড়াছড়িতে নতুন নতুন পর্যটন স্পট সংযুক্তি ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনার উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। জেলায় সাত-আট লাখ বাসিন্দার মধ্যে পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে মনে করে জেলা প্রশাসন। পর্যটন শিল্পের নান্দনিক বিকাশ ও উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে ভারতের দার্জিলিং ও শিলং অথবা নেপালের পোখারার মতো খাগড়াছড়ি একসময় পরিচিতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

খাগড়াছড়ি জেলা ও পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত একদশকে নতুনভাবে ২০-২৫টিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক পর্যটন স্পট যুক্ত হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন মনোরম স্থানকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পর্যটন স্পট। এসব স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ১৭০টি সরকারি-বেসরকারি হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও অতিথিশালা। এছাড়া চালু হয়েছে দুই-তিনশ’ ছোট-বড় রেস্তোরাঁ।

পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে ব্যক্তিগত ও সমিতিভিত্তিক ট্যুরিস্ট বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, কার, সিএনজি, চাঁদের গাড়ি, মোটরসাইকেল। জেলার নয়টি উপজেলায় পর্যটকদের সেবা দিতে দুই শতাধিক গাড়ি প্রস্তুত থাকে।

খাগড়াছড়ি পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলমের মন্তব্য, ‘পর্যটনকে কেন্দ্র করে ছোট-বড় প্রচুর গাড়ি নামানো হয়েছে। ফলে পরিবহন খাতে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পর্যটন স্পট বাড়ানো সম্ভব হলে আরও বেশি লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে সবসময় উন্নত সেবা থাকা চাই।’

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্কএছাড়া পর্যটনভিত্তিক কয়েকশ’ অস্থায়ী দোকানপাট আছে। এগুলোতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাপড়, শার্ট, পাঞ্জাবি, পিনন, পাহাড়ি পোশাক বিক্রি হয়। এছাড়া ডাব, পেঁপে, কলা, তেঁতুলসহ বিভিন্ন ফলের বিক্রি থাকে প্রতিদিন। অনেক পর্যটন স্পটে রয়েছে অস্থায়ী ফলের জুসের স্টল।

খাগড়াছড়ি মিনি সুপার মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পর্যটকদের সুবাদে খাগড়াছড়িতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। তারা স্থানীয়ভাবে তৈরি কাপড় কেনেন। মেয়েদের মধ্যে পাহাড়ি নারীদের বানানো থামী, পিনন, ব্লাউজ, কাঠের তৈরি বিভিন্ন শো-পিসের ব্যাপক চাহিদা।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়িতে এমনিতেই সবুজাভ পাহাড়ের ছড়াছড়ি। সেই সঙ্গে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী, মাইনি ও ফেনী নদী খাগড়াছড়িকে সাজিয়েছে অপরূপ সাজে। চারদিকে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজ পাহাড়, ঝরনা, প্রাকৃতিক লেক, কৃত্রিম লেক এবং ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবন-সংস্কৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্কসদর উপজেলার হর্টিকালচার পার্ক, আলুটিলার প্রাকৃতিক গুহা, হেরিটেজ পার্ক, শতবর্ষী বিশ্বশান্তি রাজ মহামুনি বৌদ্ধ চৈত্য বিহার, আলুটিলা বৌদ্ধ বিহার, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, দশবল বৌদ্ধ বিহার, চেংগী নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থাপনা, মাটিরাঙার শতবর্ষী বটগাছ, উপজেলা প্রশাসন লেক জলপাহাড়, ভগবান টিলা, রিছাং ঝরনা, মহালছড়ির মনারটেক লেক, দেবতার পুকুর, মানিকছড়ির বনলতা অ্যাগ্রো প্রাইভেট, পুরনো রাজবাড়ি, পানছড়ির অরণ্য কুঠির, মায়াবিনী লেক, রাবার ড্যাম, রামগড়ের কৃত্রিম লেক, চা বাগান, কলসী মুখ, বিজিবি’র ভাস্কর্য, দীঘিনালার হাজাছড়া-তৈদুছড়া ঝরনাসহ শতাধিক মনোরম পর্যটন স্পট রয়েছে খাগড়াছড়িতে। এখানে ঝরনা, উঁচু-নিচু পাহাড়, অবারিত পাহাড়ের সবুজ উপত্যকা দেখে মন ভরে যায় ভ্রমণপ্রেমীদের।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য খাগড়াছড়ি অত্যন্ত চমৎকার জায়গা। অনেকে নয়নাভিরাম সবুজাভ পাহাড়ের দৃশ্য, চপলা ঝরনা, সর্পিল নদী, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি উপভোগ করতে আসেন। এর সুবাদে স্থানীয় লোকজনের আয়ের প্রধান খাত এখন পর্যটন। বলা যায়, একলাখ লোক পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে পরিবার চালাচ্ছে।’

বেসরকারি হোটেল গাইরিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, খাগড়াছড়িতে প্রচুর পর্যটক আসে। বেশিরভাগ হোটেল সবসময় বুকিং থাকে। পর্যটকদের জন্য তাদের হোটেলে স্থানীয় বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার রাখা হয়। এছাড়া কেউ চাইলে নির্ধারিত ফি দিয়ে স্থানীয় শিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান উপভোগ করতে পারেন।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্কখাগড়াছড়ি হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক উল্লেখ করেন, জেলায় পর্যটনকে ঘিরে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পর্যটন খাতে অনেকে যুক্ত হচ্ছেন। এখন পর্যটন স্পট বৃদ্ধি ও নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা প্রয়োজন বলে মন্তব্য তার। বিদেশি নাগরিকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার মতে, ‘পর্যটকদের থাকা ও ব্যবহারের জন্য অবকাঠামোগুলো অত্যাধুনিক মানের করার পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্কসহ সব ধরনের ডিজিটাল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ভ্রমণপিপাসুদের রাতে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার মতো জায়গা আরও দরকার। পাশাপাশি দিনের বেলা কাছাকাছি জেলায় যাতায়াতের জন্য আধুনিক ট্যুরিস্ট বাস সেবা লাগবে।’

খাগড়াছড়িতে গড়ে ২০-৩০ হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক আসছে বলে জানান হোটেল অরণ্য বিলাসের মালিক স্বপন চন্দ্র দেবনাথ। তাদের সুবাদে জেলায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দরিদ্র, বেকার ও কর্মহীন মানুষগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে জেলার বাসিন্দাদের জীবনমান ইতিবাচকভাবে বদলেছে। পর্যটনের মাধ্যমে কম করে হলেও একলাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান পেয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবার চালানোর পাশাপাশি তারা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।’

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্কপর্যটন স্পটের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিতকরণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই হোটেল ব্যবসায়ী। খাগড়াছড়িতে আগে অনেক কৃষিজ পণ্য, ফল-ফলাদি পঁচে যেতো উল্লেখ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য আর নষ্ট হয় না। কারণ পর্যটকরা এসব কৃষিজ পণ্য ব্যবহার করায় কৃষকেরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন ও স্বাবলম্বী হচ্ছেন।’

বেসরকারি রেস্তোরাঁ স্বপ্নচূড়ার মালিক ও নারী উদ্যোক্তা নেইম্রা মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার হোটেলে এখন গড়ে দুই-তিনশ’ স্থানীয় ও বাইরের অতিথি আসে। ফলে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পর্যটন শিল্পের বিকাশে শত শত খাবারের হোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে এবং হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পর্যটন শিল্পের যেমন বিকাশ হবে, তেমনই স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।’

আলুটিলাপর্যটকদের নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে খাগড়াছড়িতে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস। জেলায় পর্যটন স্পট বাড়ানো ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা সরকারের আছে উল্লেখ করেন তিনি। তার কথায়, ‘জাতীয় বাজেটে জেলাভিত্তিক উন্নয়নের খাত হিসেবে পর্যটনকে নির্ধারণ করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে অসাধারণ কিছু পর্যটন স্পট রয়েছে। সেগুলো আরও আকর্ষণীয় করে সাজানো হবে।’

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আহমারউজ্জামান জানান, বর্তমানে জেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো। প্রচুর পর্যটক খাগড়াছড়ির প্রতিটি পর্যটন স্পটে প্রতিদিন আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় পর্যটন পুলিশসহ ডিবি ও সাদা পোশাকে পুলিশ নজর রাখছে। কেউ চাইলে তাকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য শর্তসাপেক্ষে পর্যটন পুলিশ দেওয়া হবে।’

খাগড়াছড়ির ঝরনাখাগড়াছড়ি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর দাবি, এই জেলাকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়তে সরকারের পাশাপাশি সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও শীর্ষ ব্যবসায়ীরা কাজ করছেন। তিনি উল্লেখ করেন, জেলার প্রতিটি উপজেলায় অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তোলা হচ্ছে।