মুসা বিন শমসেরের যুদ্ধকালীন অপরাধের তথ্য তদন্ত সংস্থায়

মুসা বিন শমসের (ছবি: সংগৃহীত)আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের যুদ্ধাকালীন তথ্য-উপাত্ত এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা প্রবীর শিকদার ও সাংবাদিক সাগর লোহানী তদন্ত সংস্থায় এই তথ্য-উপাত্ত হস্তান্তর করেন। তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী হান্নান খান বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

প্রসঙ্গত,  কিছুদিন আগে মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে কোনও তথ্য-উপাত্ত কারও কাছে থাকলে তদন্ত সংস্থায় পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল।

সাংবাদিক সাগর লোহানী বাংলা টিবিউনকে বলেন, ‘গত ১৬ বছরে তার (মুসা বিন শমসের) বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায়, বই-পত্রে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেসব তথ্য একত্রিত করে আমরা তদন্ত সংস্থায় ২৮ পৃষ্ঠার একটি সংকলন তদন্ত কর্মকর্তা সানাউল হকের হাতে দিয়েছি। তদন্ত সংস্থা সেগুলো গ্রহণ করেছে। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান করছেন, আমাদের তথ্য তাদের আরও সহযোগিতা করবে। অনুসন্ধান শেষে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানিয়েছেন।’

সাগর লোহানী আরও বলেন, ‘আমরা তাদের বলেছি, শিগগিরই অনুসন্ধান শেষ করে করে মুসা বিন শমসেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ তার যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তার বিনিময়ে তিনি সাক্ষী ম্যানে করে ফেলতে পারেন। ফলে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া কঠিন হবে।’  

এদিকে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী হান্নান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারা এসেছিলেন, কাগজপত্র দিয়ে গেছেন। আমরা সেগুলো অনুসন্ধান করে যদি সত্যতা পাই, তাহলে তদন্ত করব।’

১৯৭১ সালে যারা ফরিদপুরে ছিলেন, তারা মুসা বিন শমসেরকে চেনেন হত্যা ষড়যন্ত্র আর নির্যাতনের অনন্য উদাহরণ হিসেবে। মুসা বিন শমসেরের যুদ্ধকালীন অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকার পরও তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে তার অপরাধ তদন্ত হয়নি। তারা এখনও সম্ভাব্যতা অনুসন্ধান করছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে মুসার অপরাধের শিকার ও প্রত্যক্ষ সাক্ষীরা বলছেন, তার অপরাধের কথা মানুষ ৪৫ বছর ধরেই বলছে। তারপরও নতুন করে কোনও নাগরিক অভিযোগ না করলে মুসা নির্দোষ হয়ে যাবে? তদন্ত সংস্থা কি পারে না নিজেদের উদ্যোগে বিচারের উদ্যোগ নিতে?
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ‘অনুসন্ধান’ করছেন। তবে তা কেস ফাইলে ওঠে নাই। যদি কোনও সংশ্লিষ্টতা পান তবে তা নথিভুক্ত করে তদন্ত করা হবে। কবে নাগাদ এ ‘অনুসন্ধান’ শুরু হয়েছে আর কবে শেষ হবে, সে বিষয়ে তারা কিছু বলতে চাননি।
অভিযোগ আছে, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ফরিদপুরে ঢোকার ব্যাপারে মানচিত্র ও পথনির্দেশনা দিয়ে নেপথ্যে সহযোগিতা করেছেন এই মুসা। প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা পরদিন ২২ এপ্রিল ফরিদপুর সার্কিট হাউসে মেজর আকরাম কোরায়শী ও মুসা বিন শমসেরকে অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলাপরত দেখতে পান। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়েই মুসার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনার সাক্ষী ফরিদপুরবাসী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডিসেম্বরেই মুসা ফরিদপুর ত্যাগ করেন।
এদিকে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ও ফাঁসি কার্যকর হওয়া শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলার সাক্ষীরা তদন্ত কর্মকর্তাদের সামনে সাক্ষ্য দিতে এসে মুসা বিন শমসেরের কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের প্রশ্ন, একাত্তরে মুসার ভূমিকা ও তার সপক্ষে প্রমাণ থাকলেও এখনও কেন ‘অনুসন্ধান’ পর্যায়ে থাকতে হচ্ছে। সেই জায়গা থেকেই সাংবাদিক প্রবীর শিকদার ও সাগর লোহানী তাদের কয়েক দশকের সংগ্রহ তুলে দিয়েছেন তদন্ত সংস্থার হাতে।
মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে ‘অনুসন্ধানে’র সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক প্রবীর সিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুসা বিন শমসেরকে গ্রেফতার না করে তার বিরুদ্ধে তদন্ত বা অনুসন্ধান যা-ই বলি না কেন, সেটা করতে পারা সম্ভব না। তার পারিবারিক যে রাজনৈতিক পরিচিতি, তার ওপর তার দাপটের কারণে কেউ কিছু জানাবে না।’
প্রবীর সিকদার আরও বলেন, ‘কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনুসন্ধান শেষ হলে তদন্ত শুরু হবে— এসব আসলে মুসাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার কৌশল কিনা, সেটাও প্রশ্ন।’ তিনি বলেন, ‘নিজামী, মুজাহিদ, সাকা, কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানকে যদি ৫৪ ধারায় আগে গ্রেফতার করে যুদ্ধাপরাধের অনুসন্ধান তদন্ত করা যায়, তবে নুলা মুসার ক্ষেত্রে আগে কেন গ্রেফতার নয়?’
মুসার বিরুদ্ধে কোনও সাক্ষী বা ভিকটিমকেই অভিযোগ করতে হবে কিনা— এ প্রশ্নে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রসিকিউটর বলেন, ‘এ ধরনের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। অভিযোগকারী তদন্ত সংস্থা থেকেও হতে পারে। তারা অনুসন্ধান করে যদি মনে করেন তা মামলাভুক্ত করতে হবে, তাহলে করবেন। এতে কোনও বাধা নেই।’

জেএ/ এমএনএইচ/