‘ঢাকা সনদ’ তৈরি করেছিল স্বঘোষিত ইমাম মাহাদী!

 

র‌্যাবের হাতে আটক স্বঘোষিত ইমাম মাহাদী
ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করে আসছিল স্বঘোষিত ইমাম মাহাদী। ইতোমধ্যে অর্ধশত ব্যক্তিকে নিজের অনুসারী বানিয়ে ফেলেছিল সে। তাদের জন্য তৈরি করেছিল মুসাফির খানা। নিজের অর্থব্যয় করে অনুসারীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করতো। সঙ্গে চলতো ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড। প্রচার করতো ভ্রান্ত মতবাদের লিফলেটও। নিজের ভ্রান্ত মতবাদের আলোকে মানুষকে ভুল পথে নেওয়ার লক্ষ্যে তৈরি করেছিল ‘ঢাকা সনদ’ও। এলিট ফোর্স র‌্যাব দীর্ঘ গোয়েন্দা নজরদারির পর বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর শাজাহানপুর এলাকার একটি বাসা থেকে র‌্যাব-১১-এর একটি দল আটক করে তাকে। তার প্রকৃত নাম আলক্বাযী মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন (৪৫)। এ প্রসঙ্গে র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, ‘এর আগে গ্রেফতার হওয়া বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবকালে তারা এই কথিত ইমাম মাহাদী মঈন উদ্দিনের কথা বলেছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ীই  গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তাকে আটক করা হয়েছে।’

র‌্যাব জানায়, কথিত ইমাম মাহাদীকে আটকের সময় তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট, কথিত ঢাকা সনদের কপি, ভ্রান্ত মত্যবাদের ব্যাখ্যা সংবলিত লিফলেট  ও এসব তৈরিতে ব্যবহৃত কম্পিউটার ও প্রিন্টার জব্দ করা হয়েছে।

লে. কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, ‘আটক মঈন উদ্দিন ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ভ্রান্ত মতবাদ প্রচারের চেষ্টা করছিল। এছাড়া সে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লিফলেট বানিয়ে প্রচার করে আসছিল। সে নিজের মতো করে ‘ঢাকা সনদ’ তৈরি করে অনুসারীদের কাছে বিলি করতো।

মঈন উদ্দিনের বাসা থেকে যে ‘ঢাকা সনদ’ উদ্ধার করা হয়েছে উল্লেখ করে র‌্যাব সূত্র জানায়, ওই ‘সনদে’ প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নিজেকে দাবি করেছে সে। তার দাবি, শিগগিরই অন্য দু’টি পক্ষ, ১৪ দল ও ২০ দল সমন্বিতভাবে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। সে নিজে সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত ইমাম মাহাদী দাবি করে দেশে তার তৈরি করা ঢাকা সনদের আদলে পরিচালনা করবে বলে লিফলেট তৈরি করেছে।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কথাবার্তা শুনে তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হলেও সে যা করছে, তা আসলে আইনবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড। তবে প্রাথমিকভাবে তার সঙ্গে কোনও জঙ্গি সংগঠনের সরাসরি যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়নি। তার কোনও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একইসঙ্গে তার নিজের জীবনেরও ঝুঁকিও ছিল। এর আগে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে সহযোগীসহ কথিত এক ইমাম মাহাদী খুন হয়েছিল। জঙ্গিদের কোনও একটি দল তার মতবাদের জন্য তাকে টার্গেট করে হত্যার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারতো।’

মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন ১৯৮৬ সালে ফেনীর আলীয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেন, এরপর ঢাকার মাদ্রাসা-ই-আলিয়া থেকে ফাজিল ও কামিল পাস করে সে। এরপর ১৯৮৮-১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৯৩ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৯৫ সালে একই বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে। পরবর্তী সময়ে সে ‘নজরুল সাহিত্যে ইসলামি ভাবধারা’ এবং ‘আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব’ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিলের ১ম পর্ব শেষ করেছে বলে দাবি করছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্মীয় মতবাদের অপব্যাখ্যাকারী নিজেকে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মনোনীত বিশেষ দূত, অনুগত দাস, ইসলামের খলিফা ও ইমাম মাহাদী হিসেবে দাবি করছে।  ইতোমধ্যে সে ৩০-৪০ জনের একটি অনুসারী দল তৈরি করেছে। তার নিজ বাসায় সে তার অনুসারীদের উগ্রবাদী ও রাষ্ট্রবিরোধী বিষয়ে দীক্ষা দিতো। মাঝে মধ্যেই তার বাসায় ১০-১৫ জন অনুসারী নিয়ে গোপন বৈঠক করতো। তার উদ্দেশ্য ছিল, অনুসারীদের মধ্যে তার নেতৃত্বে দেশে ধর্মীয় শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করা। এ কারণে সে নিয়মিত অপপ্রচার সংবলিত লিফলেট বিলি করতো।

র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলেন, মঈন উদ্দিনের দাবি, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাপ্ত পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদগুলো ঠিক নয়। এই কারণে সে নিজে কোরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের খসড়া তৈরির কাজ করছিল বলে জানায়। তারা বলেন, গ্রেফতারকৃত আলক্বাযী মোহাম্মদ মঈন উদ্দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে যেকোনও মুহূর্তে সামাজিক ও ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা তৈরির আশঙ্কা ছিল। সে উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকেও লক্ষ করে অপপ্রচার চালাতো। অবিবাহিত এই কথিত ইমাম মাহাদীর গ্রামের বাড়ি ফেনীতে। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ ছাড়া তার আর কোনও আয়ের উৎস নেই। নিজ বাসাকে সে মুসাফির খানা বানিয়ে সেখানে অনুসারীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতো। অভিযানের সময় মঈন উদ্দিনের সঙ্গে তার ৬ সহযোগীকেও আটক করা হয়েছিল। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।’

র‌্যাব কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘গ্রেফতারের পর মঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে শাজাহানপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঈন উদ্দিনকে থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।’