অ্যাপে অভিযোগ: প্রতিকার এখন আরও সহজ

পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেবা এখন হাতের মুঠোয়। যেকোনও মোবাইল ফোন থেকে এসব বাহিনীর হটলাইনে ফোন করে সেবা পাওয়া যাচ্ছে থানায় যাওয়ার ঝক্কি এড়িয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের সেবা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। আর স্মার্টফোন থাকলে অভিযোগকারীর সুযোগ আরও বেশি। পুলিশ, র‌্যাব, সন্ত্রাসবিরোধী ফোর্সের অ্যাপে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের তথ্য দিয়ে যেমন সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি ছবি কিংবা ভিডিও দিয়ে এসব ফোর্স জনগণ সহায়তাও করতে পারছেন। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক, খুন, ডাকাতি, অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধে এসব অ্যাপ ব্যবহার করে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে।

২০১৬ সালে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার পর থেকে সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে বেশ তৎপর হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জনসম্পৃক্ততার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তথ্য-প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াকে আরও বেগবান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এ পর্যন্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জনকল্যাণে চারটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্লিকেশন উন্মুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে পুলিশ সদর দফতরের ‘বিডি পুলিশ হেল্প লাইন‘ (BD Police Help Line); কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ‘হ্যালো সিটি’ (Hello CT), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’ (Report to Rab) এবং অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) ‘ইনফর্ম এটিইউ’ (Inform ATU)। এসব বাহিনী স্ব-উদ্যোগেই মোবাইল অ্যাপগুলো তৈরি করেছে। ইন্টারনেটের সাহায্যে যেকোনও অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করা যাবে এসব অ্যাপ। ইন্টারনেটে যুক্ত থেকে যে কোনও সময়, যেকোনও জায়গা থেকে তথ্য দেওয়া যাচ্ছে অ্যাপগুলোয়। যেকোনও বয়সী নাগরিক, যেকোনও শ্রেণিপেশার যে কেউ অ্যাপের মাধ্যমে অপরাধের তথ্য জানাতে পারছেন। অ্যাপগুলো নিজেদের মোবাইলে প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করে যে কেউ অভিযোগ জানাতে পারেন।

অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য চাওয়া হচ্ছেএসব অ্যাপ থেকে সুবিধা পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। অ্যাপগুলো থেকে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য পাচ্ছেন তারা। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এরপর বিভিন্ন ধরনের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

বাহিনীগুলো বলছে, অভিযোগকারীর পরিচয় তারা গোপন রাখেন। তবে অনেক সময় অভিযোগকারী নিজের পরিচয়, ফোন নম্বর বা ঠিকানা না দেওয়ায় কিছু বিষয়ে তদন্তে এগোনো যায় না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, অ্যাপসে আসা সব তথ্য ও অভিযোগ আমলে নিয়ে সত্যতা যাচাই করা হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধের ধরন বিবেচনা করে যে বাহিনীর যতটুকু কাজ তারা তা তদারকি করে।

জনগণ এখন অনেক সচেতন উল্লেখ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, অ্যাপসের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে তথ্য পাচ্ছেন তারা। এই অ্যাপগুলোর মাধ্যমে জনগণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না করেও অভিযোগ দিতে পারছেন। এতে অনেকেই উপকৃত হচ্ছেন, বিশেষ করে যারা সরাসরি গিয়ে থানায় অভিযোগ করাকে বিড়ম্বনা মনে করেন।

কী ধরনের তথ্য আসছে

‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপটি মূলত জঙ্গি তথ্যের সন্ধানে তৈরি করা হয়েছিল। তবে এর মাধ্যমে জঙ্গি বিষয়ক তথ্য আসে কম। সাইবারক্রাইম বিষয়ক তথ্য আসে বেশি। বাংলা ট্রিবিউনকে এ কথা জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের (সিটিটিসি) সাইবার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার সাঈদ নাসিরুল্লাহ।

অপরাধের ধরণতিনি জানান, প্রতিনিয়ত হ্যালো সিটি অ্যাপে অভিযোগ আসছে। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় আমলে নেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনগত (জিডি) ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

অ্যাপের বাইরে ফেসবুক এবং ইমেইলের মাধ্যমেও অভিযোগ পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।

সিটিটিসি’র তথ্য অনুযায়ী, হ্যালো সিটি অ্যাপে ২০২০ সালে ৩৪২টি অভিযোগ এসেছে। ২০১৯ সালে এসেছিল ৯৪৭টি। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট অভিযোগ এসেছে এক হাজার ৪৫৭টি। এছাড়া ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে ২০২০ সালে অভিযোগ পাওয়া যায় পাঁচ হাজারের বেশি।

তথ্য যাচাই করে গুরুত্ব অনুযায়ী ব্যবস্থা

র‌্যাবের ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’ অ্যাপের বিষয়ে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কী পরিমাণ অভিযোগ এসেছে কেন্দ্রীয়ভাবে তার কোনও তথ্য তাদের কাছে নেই। কেউ অভিযোগ করলে তা নির্দিষ্ট থানার সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায়। যারা তথ্য দিয়ে থাকেন, এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে র‌্যাব সেগুলো যাচাই-বাছাই করে থাকে। অভিযোগে দেওয়া তথ্যের সত্যতা পেলে সেসব বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

তিনি জানান, গত এক সপ্তাহে ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’ অ্যাপ থেকে ৩৮৬টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে আমলে নেওয়ার মতো অভিযোগ ছিল ১৪ থেকে ১৫টি।

অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য চাওয়া হচ্ছেজঙ্গিবিরোধী অভিযান চালানোর মতো কোনও তথ্য অ্যাপে পাওয়া যায় কিনা বা এ ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে কী ধরনের অভিযান পরিচালিত হয় সে বিষয়ে জানতে চাইলে আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে জঙ্গি বিষয়ক অভিযোগ ছাড়াও নানা অপরাধের বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে থাকি। সংশ্লিষ্ট র‌্যাব ব্যাটেলিয়ানসহ গোয়েন্দা শাখা এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিতে কাজ করে। সত্যতা পেলে অভিযান পরিচালনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। সব সময় বলা হয়ে থাকে, অভিযোগকারী কিংবা তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখা হবে। তবে কেউ তথ্য জানানোর সময় নিজের নাম ও যোগাযোগের নম্বরটি উল্লেখ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরবর্তী সময়েও তাকে সহায়তা করতে পারে।’

নতুন হলেও অভিযোগ আসে অনেক

অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) পরিচালিত অ্যাপ ‘ইনফর্ম এটিইউ’তে প্রতিনিয়ত জমা পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ। এ বিষয়ে সংস্থাটির মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস শাখার পুলিশ সুপার আসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের অপরাধের তথ্য আসছে অ্যাপটিতে। অপরাধের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এবং অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের এখতিয়ারভুক্ত অপরাধগুলো বেছে নিয়ে কাজ করা হয়। জঙ্গি তৎপরতা সংশ্লিষ্ট অভিযোগ করছেন অনেকে। সেসব বিষয় খতিয়ে দেখে অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গিদের গ্রেফতার করাও সম্ভব হচ্ছে। অভিযোগকারীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। বাহিনীটি ২০১৮ সাল থেকে দেশব্যাপী জঙ্গিবাদ বিষয়ক অভিযান পরিচালনার সুযোগ পায়। এটিইউ বাংলাদেশ পুলিশের নতুন একটি সংস্থা হলেও অ্যাপে অনেকেই অভিযোগ করছেন।’

তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাক, ফেইক আইডি, অনলাইন ব্যবসায় প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিং বিষয়ক প্রতারণা, ব্যক্তিগত ছবি কিংবা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, রাজনৈতিক অপপ্রচার, ধর্মীয় উগ্রবাদ বিষয়সহ নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে অ্যাপের মাধ্যমে।

তথ্য সংগ্রহে কার্যকর

পুলিশ সদর দফতর পরিচালিত ‘বিডি পুলিশ হেল্প লাইনে’ অনেকেই তথ্য দিচ্ছেন এবং অ্যাপটি তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার এআইজি সোহেল রানা। তিনি জানান, অ্যাপে নানা ধরনের অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দফতরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। জনগণের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধ দমনে অনেকাংশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কার্যকর হয়ে উঠছে অ্যাপগুলো।