যেভাবে বিদেশ থেকে আনা হয় এলএসডি মাদক

বিভিন্ন দানাদার শস্য থেকে প্রথমে সংগ্রহ করা হয় লাইসারজিক এসিড। সেই এসিড থেকে তৈরি করা হয় ক্রিস্টাল। ক্রিস্টাল গলিয়ে করা হয় তরল। সেই তরল ছোট ছোট ব্লটার পেপারে মাইক্রোগ্রাম অনুপাতে মেশানো হয়। কার্টুনের ছবি সংবলিত সেই ব্লটার পেপারগুলো কুরিয়ারে আনা হয় দেশে। সাদা চোখে দেখে এটি যে ভয়ংকর মাদক এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড)সেটা বোঝার উপায় নেই। দেশে আনার পর সেই ব্লটার পেপারগুলো প্রতি পিস হিসেবে বিক্রি করা হয় মাদকসেবদীদের কাছে। মাদকসেবীরা জিহ্বায় ভিজিয়ে এই এলএসডি মাদক গ্রহণ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করতে গিয়ে দেশে এলএসডি নামে নতুন এই মাদকের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এলএসডি মাদকের  দুইশ’ ব্লটার পেপার উদ্ধারের পাশাপাশি তিন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো— নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র ছাত্র সাদমান সাকিব রূপল ও আসহাব ওয়াদুদ তুর্জ এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফ। তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, ‘এলএসডি মাদক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের আরও কিছু সদস্যকে তারা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছেন। তাদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীরা কীভাবে বিদেশ থেকে এসব মাদক আনতো তা জানার চেষ্টা চলছে।’

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এলএসডি মাদক অনেক পুরনো হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার নতুন। এই মাদক অনেক বেশি ব্যয়বহুল। গত কয়েক বছর ধরে এলএসডি উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে এই মাদক দেশে আনা হচ্ছে। স্টিকার বা তরল পানি শোষণ করে রাখে— এমন কাগজ ব্যবহার করে এটি দেশে আনা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই মাদকের ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ছে।

এলএসডি সেবনের পর নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন ঢাবি ছাত্র হাফিজুর রহমানগোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশে এলএসডি মাদক ছোট্ট ট্যাবলেটে রূপান্তর করে বা ক্যাপসুলের মাধ্যমেও বিক্রি হয়। কিন্তু এপর্যন্ত তারা যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে দেশে এখনও ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল কেউ আনেনি। তুলনামূলকভাবে ব্লটার পেপার বা পানি শোষণকারী কাগজের মাধ্যমে আনা সহজ এবং এতে বিমানবন্দরের কেউ সন্দেহ করে না বলে এই পদ্ধতিতেই দেশীয় মাদক ব্যবসায়ীরা এলএসডি আনছে। এলএসডি মাদক চক্রে জড়িত একটি ফেসবুক গ্রুপের প্রায় এক হাজার সদস্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই গ্রুপের বেশিরভাগই এলএসডি  সেবনকারী। নেশায় আসক্ত হওয়ার পর নিজের ব্যবহারের জন্য অর্থ যোগাতে কেউ কেউ এলএসডির ব্যবসাও করছেন। এরকম বেশ কয়েকজনকে শনাক্তের পর তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযানও শুরু করেছে গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনাল টিম।

গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তিন শিক্ষার্থীকে এলএসডি মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন— এসব মাদক তারা নেদারল্যান্ড থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে এনেছিল। প্রতি ব্লটার পেপারের মাধ্যমে এলএসডি মাদক আনতে তাদের খরচ পড়েছে এক হাজার টাকার মতো। তারা নিজেরা সেবনের পাশাপাশি প্রতি ব্লটার তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় মাদকসেবীদের কাছে বিক্রি করতো।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রায় অর্ধ শত স্ট্রিপ এলএসডি মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি দুই তরুণকে গ্রেফতার করেছিলেন তারা। অন্যান্য মাদকের তুলনায় এটি অনেক বেশি ভয়ংকর বর্ণনা দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটি সেবনের পর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে কমে যায়। তখন যে কেউ যেকোনও কিছু  করে ফেলতে পারে। ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুরের বেলায় এমনটিই ঘটেছে। এলএসডি সেবনে হাফিজুরের মৃত্যুর পর তারাও এই মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করেছেন।

আরও পড়ুন:

ঢাবি ছাত্র হাফিজুরের মৃত্যু তদন্তে নতুন মাদকের সন্ধান, তিন বন্ধু গ্রেফতার