হাইকোর্টে সিআইডির প্রতিবেদন

রাজারবাগ দরবার শরিফে পীরের ‘মামলা সিন্ডিকেট’

ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মানবপাচারসহ অন্যান্য অভিযোগে ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়। অপরাধ না করেও এসব মিথ্যা মামলার আসামি হওয়া থেকে বাঁচতে তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন হাইকোর্টের। তার রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে মামলার বাদীদের খুঁজে বের করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় সিআইডি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর সিন্ডিকেট কর্তৃক হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের বিষয়টি ওঠে আসে।

আজ বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রতন কৃষ্ণনাথ হাইকোর্টে এ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রিট আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৪৯টি মামলা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে জিআর মামলা ২৩টি এবং সিআর মামলা ২৬টি। ইতোমধ্যে জিআর ১৫টি মামলা এবং সিআর ২০টি মামলায় আবেদনকারী আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। এরমধ্যে ৮টি জিআর এবং ৬টি সিআর মামলা রয়েছে। রিট পিটিশনে পক্ষভুক্ত ২০ জন ব্যক্তি আদালতে বাদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা দায়ের করেছেন। তাদের ছাড়াও আরও একাধিক ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে, যারা আবেদনকারীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক একাধিক মামলার বাদী ও সাক্ষীর ভূমিকা পালন করেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, হত্যার চেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় ঢাকাসহ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলো সম্পর্কে প্রকাশ্য ও গোপনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী, ভুক্তভোগীরা কোনও না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং ওই দরবার শরিফের পীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান তার মুরিদ ও অনুসারীদের দিয়ে মামলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন প্রকার হয়রানির বিষয়ে ২০২০ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অভিযোগ পেয়ে তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে একটি তদন্ত পরিচালনা করে বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।

মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা তাদের দরবার শরিফের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য নিরীহ জনসাধারণের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে আসছে। ওই প্রতিবেদনে একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর সিন্ডিকেটের করা হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়ায়ও বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আকারে প্রচার হয়েছে বলে সিআইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

রিট আবেদনে পক্ষভুক্ত ব্যক্তিরা এবং তদন্তকালে পাওয়া ব্যক্তিরাই কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমানের অনুসারী এবং মুরিদ হিসাবে তথ্য-প্রমাণে প্রতীয়মান হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।

সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এবং এক বোন। ১৯৯৫ সালে তার বাবা ডা. আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার শরিফের পিছনে ৩ শতাংশ জমির ওপর ৩ তলা পৈতৃক বাড়ি তাদের। বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তর-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু রিট আবেদনকারী ও তার অপর ভাই ডা. কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেও ওই পীরের মুরিদ করা যায়নি। এরইমধ্যে রিট আবেদনকারীর মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির অধিকাংশই পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আবেদনকারী ও তার ভাইয়ের প্রাপ্য অংশটুকু পীর এবং তার দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য ওই দুই ভাইয়ের ওপর দরবার শরিফের পীর দিল্লুর এবং তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু তারা সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের সঙ্গে আবেদনকারীর শত্রুতা সৃষ্টি হয়। শত্রুতার কারণেই আবেদনকারীর বিরুদ্ধে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এসব হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে পীর দিল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীরা।

সিআইডির ওই তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মামলাগুলো দায়েরের পেছনে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান এবং ওই প্রতিবেদনে উল্লেখিত সব অনুসারী তাদের অশুভ স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত।

তদন্তে ওঠে আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আদালতের নির্দেশনা প্রার্থনা করে সিআইডি।

রিটকারী কাঞ্চনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমাদুল হক বসির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা আজ কোর্টে সিআইডির প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলাম। আদালত এ বিষয়ে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর শুনানি ও আদেশের দিন নির্ধারণ করেছেন।

প্রসঙ্গত, এ ঘটনা তদন্ত করতে সিআইডিকে গত ১৪ জুন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিলেন।